শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে আসা নতুন সংবেদন মাহিশ থিকশানা। একেবার চূর্ণ-বিচুর্ণ এক অতীতকে পিছনে ফেলে উঠে এসেছেন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই নিজের ক্যারিশমা দেখিয়েছেন এই অলরাউন্ডার। এত এত মানুষের আগ্রহ, কোটি কোটি টাকার হাতছানি, শত শত ক্যামেরা কিংবা অটোগ্রাফের আহবানে উল্লসিত হন নিশ্চয়ই, তবে মোহিত হন না।
নিজের শিকড় কিংবা ওই অতীতকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চান। ওই ছাইয়ের স্তুপ থেকে নিয়ে আসতে চান তাঁর মত আরো অনেক অগ্নি গোলাকে। এই মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়েছেন মাহিশ থিকশানা।
দুই ফরম্যাটেই খেলেছেন একটি করে ম্যাচ। ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচেই তুলে নিয়েছেন চার উইকেট। লো স্কোরিং ম্যাচে দলের বিপদের সময় ব্যাট হাতেও হাল ধরেছিলেন। তাঁর বোলিং তোপে মাত্র ১২৫ রানেই গুটিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সাত বছর পর র্যাংকিং এর সেরা পাঁচ দলের কারো বিপক্ষে সিরিজ জিতলো শ্রীলঙ্কা।
এই জয়ের অন্যতম নায়ক মানিশ থিকশানা বড় হয়েছেন তাঁর দাদির কাছে। তাঁদের গ্রামের ছোট্ট একটি বিদ্যালয়ে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। সেইসময় স্কুল ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত দুইজন কলেজ ছাত্রের চোখে পড়েন মানিশ। তারাই মাহিশের দিদাকে প্রথম তাঁর ক্রিকেট প্রতিভার কথা জানান।
এরপর মাহিশকে শহরে পাঠানোর অনুমতি চান প্রতিযোগিতা মূলক ক্রিকেট খেলার জন্য। তাঁদের কলেজ সেন্ট বেনেডিক্ট আবার খেলাধুলার প্রতি বেশ জোর দিত। ফলে কলেজের পক্ষ থেকে দুইবছরের স্কলারশিপ দেয়া হয় মানিশকে।
সেন্ট বেনেডিক্ট শ্রীলঙ্কার অন্যতম সেরা ক্রিকেট স্কুল ছিল। ফলে মানিশের প্রতিভা তাঁরা সহজেই বুঝতে পেরেছিল। দুইবছর পরে কলেজ তাঁকে পুরোপুরি স্কলারশিপ দেয়। এটা তাঁদের জন্যও দারুণ একটা সিদ্ধান্ত ছিল। দেশের সেরা ক্রিকেট স্কুল হলেও ১৯৭৯ সালের পর থেকে তাঁদের স্কুল থেকে কেউ জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারেনি। তাঁদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছেন মানিশ থিকশানাই।
স্কুলে থাকতেই মাহিশ অল আইসল্যান্ড বেস্ট অলরাউন্ডার অ্যাওয়ার্ড পান। এরপর তিনি ক্রিকেট খেলার জন্য যোগ দেন শ্রীলঙ্কা আর্মিতে। সৌভাগ্যবশত সেখানে দারুন দুইজন মেন্টর পান মাহিশ। শ্রীলঙ্কার দুই সাবেক অধিনায়ক দীনেশ চান্দিমাল ও থিসারা পেরেরার নজরে পড়েন মাহিশ। এরপর মাত্র ১৭ বছর বয়সের লিস্ট এ এবং ১৮ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি।
২১ বছর বয়সী এই বোলিং অলরাউন্ডারের ঝুলিতে আছে মাত্র তিনটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা। এরমাঝেই শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তবে মানিশের জীবনের মূল বাকবদলটা হয়েছিল গতবছর। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হয় লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগের (এলপিএল) প্রথম আসর।
তবে এই আসরের প্লেয়ার ড্রাফটে নাম ছিল না তাঁর। তিনি ছিলেন সাপ্লিমেন্টারি ক্যাটাগরিতে ফলে ওই আসরে তাঁর খেলার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তখন থিসারা পেরেরা জাফনা স্টেলায়ন্সকে মাহিশের প্রতিভার কথা বলেন। অধিনায়ক পেরেরা কথায় রাজি হন জাফনার কর্মকর্তারা। ফলে জাফনা মাহিশকে সাপ্লিমেন্টারি থেকে এমার্জিং ক্যাটাগরিতে আনার ব্যবস্থা করে। এরপর তাঁকে দশ হাজার ডলারে কিনে নেয় জাফনা।
তবে মানিশ যে তাঁর অতীতকে ভুলে যাননি কিংবা এত টাক, ফেম যে তাঁকে মোহিত করতে পারেনি তাঁর প্রমাণ দেন। জাফনা থেকে টাকাটা পেয়েই প্রথমে ফোন করেন তাঁর কলেজের স্পোর্টস ইন চার্জকে। তিনি জানান কন্ট্রাক্টের এই টাকার একটা অংশ তিনি কলেজের স্পোর্টস ফান্ডে দিয়ে দিতে চান। যাতে তাঁর মত আরো অনেককেই স্কলারশিপ দিতে পারে কলেজ। অতীতকে আগলে রাখা এই ক্রিকেটারের এখনো অনেক পথ হাটা বাকি। তবে তিনি যে অল্পতেই খুশি হবার নন তাঁর প্রমাণ ইতোমধ্যেই মিলেছে।