১৯৯৪ সালে তখন আমরা পাকিস্তানে সিরিজ খেলতে গিয়েছিলাম। করাচিতে ছিল সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। এটা ছিল ক্যাপ্টেন হিসেবে মার্ক টেলরেরও প্রথম ম্যাচ। যখন চতুর্থ দিনের খেলা শেষ হল তখন পাকিস্তানের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ১৫৫ রান। জয়ের জন্য তাদের প্রয়োজন ৩১৪ রান।
তখন আমি টিম মের সাথে হোটেল রুমে বসে ছিলাম। তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠলো।
হ্যালো শেন, আমি সেলিম মালিক (তখন তিনি পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন ছিলেন) বলছি।
গুড ডে, মেট, কেমন আছো?
খারাপ না। দেখ আমি কি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে পারি।
হ্যা অবশ্যই, কি খবর?
না, দয়া করে তুমি কি আমার রুমে আসতে পারবে?
কি জন্য?
কিছু কথা বলবো।
আমিতো আমার রুমে (টিম) মে’র সঙ্গে বসে রয়েছি।
না, না, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ – তোমাকে আমার রুমে আসতেই হবে।
আমি মনে করেছিলাম, সিরিয়াস কিছু একটা ঘটেছে। তাই আমি ভাবলাম সবকিছু ঠিকই আছে, আমার একবার যাওয়া উচিৎ, আরেকবার ভাবলাম যাওয়া ঠিক হবে না।
আমি চিন্তা করলাম এখন সে আমার কাছে কি চায়?
আমি ফোনটা রেখে দিলাম, তখন মেইসে (টিম মে) বললো কে ছিল? আমি বললাম ‘বড়ো ইদুর’। এটা ছিল তার নিকনেম, কারণ আমরা ভাবতাম তাকে ইদুরের মতোই দেখা যায়, এর মানে এই নই যে সে ইদুর ছিল। এই মুহূর্তে তো অবশ্যই নয়।
আমি গেলাম তাঁর রুমে । সে তখন কুর্তা ধরণের এক পোশাক পরে ছিল।
আসার জন্য ধন্যবাদ।
অবশ্যই, আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? ফোনে তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিল।
আমরা কালকে হারতে চাই না।
ভালো, আমরাও জিততে চাই, তোমরাও জিততে চাও, এটাতো একটা দারুণ খেলা হবে।
না, না, তুমি বুঝতে পারছো না।
সত্যি আমরা কালকে হারতে চাই না।
তুমি কি বোঝাতে চাইতেছ যে হারতে চাও না?
আমরা কালকে হারতে চাই না। এটা পাকিস্তান দল এবং দলের খেলোয়াড়দের অনেক সমস্যা হবে। মানুষজন বাড়িঘরে আগুনও দিতে পারে।
আমি তাকে বলেছিলাম, এটি দুর্ভাগ্যজনক। তবে আমি এখানে জিততে এসেছি। আমরা ভালো অবস্থানে আছি, উইকেটও টার্ন করছে। আমি মনে করি কালকে আমি ভালো বল করতে পারবো এবং সম্ভবত ম্যাচটা আমরা জিতে নিবো।
মালিক বললো, আমার কথা শোন আমরা আগামীকাল হারতে চাই না। এটা তোমার উপরই বেশি নির্ভর করছে।
আমি তখন ভাবলাম সে কি বলতে চাচ্ছে?
তারপরে সে বোমাটা ফাটাল!
আমি তোমাকে এবং টিম মে প্রত্যেককে দুই লাখ ডলার দিতে প্রস্তুত আছি। শুধু তোমাকে আগামীকাল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল করতে হবে।
আধা-ঘণ্টার মধ্যে টাকা তোমার রুমে ডেলিভার হয়ে যাবে।
কি! দু:খিত, তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?
আমরা কালকে হারতে চাই না, ড্র হলেও চলবে।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম প্রত্যেককে দুই লাখ ডলার দিবে। এটা শুনে আমি অনেকক্ষণ হাসলাম। তারপরে আমি দেখলাম এটা নিয়ে সে খুব সিরিয়াস। তার চোখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছিল।
হ্যাঁ, আমি সিরিয়াস। আধা ঘণ্টার মধ্যে টাকা পেয়ে যাবে।
আমি বললাম এসব কি বলছো, আমরা তো আগামী দিন জয় পেতে যাচ্ছি।
তাহলে কি তুমি টাকা চাও না?
অবশ্যই, আমি টাকা চাই, কিন্তু এটা তোমার থেকে নয়। আমরা আগামীকাল টেস্ট ম্যাচ জিতবো এবং আমি বলতে চাই এ কাজ আমি করতে পারবো না।
এটা নিয়ে একটু চিন্তা করো এবং সকালের আগে আমাকে জানাও, কোন তাড়া নেই।
এটা নিয়ে চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা আগামীকাল জিততে চলেছি, গুড লাক, দেখা হবে কালকে।
আমি তখন করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছিলাম, আমার বুক কাঁপছে এবং আমি চিন্তা করছি, ‘এই মাত্র আমার সাথে এসব কি ঘটলো!’
আমি রুমে গেলাম এবং মেইসিকে বললাম, তুমি ভাবতেও পারবে না, এই মাত্র কি ঘটে গেল। আমাকে বলো। সে (সেলিম মালিক) আমাকে এবং তোমাকে আধা ঘণ্টার মধ্যে দুই লাখ ডলার করে দিতে চায় শুধুমাত্র অফ-স্ট্যাম্পের বাইরে বল করার জন্য। সে বললো আমার দরকার নাই দুই লাখ ডলার, এই কাজ করার জন্য।
তারপরে কিছুক্ষণ নীরবভাবে কেটে গেল। সে আমার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণের জন্য নিরবতা। তারপর সে বললো, হ্যাঁ আমি সিরিয়াস, টাকা আমার প্রয়োজন নাই।
তারপর আমরা একত্রে হাসলাম। আমরা এখন কি করবো? তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এটা আগে মার্ক টেলর এবং বব সিম্পসনকে জানানো দরকার। তারপর আমরা তাদের ফোন করলাম এবং আমাদের রুমে মিটিংয়ের আয়োজন করলাম। এটা ছিল (অধিনায়ক হিসেবে) মার্ক টেলরের প্রথম টেস্ট ম্যাচ আর এটা সে অবশ্যই জিততে চাইবে। ব্যাটিংয়ে সে ইতিমধ্যেই দুই ইনিংসেই শূন্য (০) রানে আউট হয়েছে। বাক্তিগতভাবে ম্যাচটা তাঁর ভালো যায়নি।
আমরা সংক্ষেপে তাদেরকে ঘটনাটা বললাম। এটা বলার পর তাদের মুখের অভিভক্তি হয়েছিল দেখার মতো। ২ লাখ ডলার! সে এটা কোথায় পেয়েছে। এটা আমার জন্য খুব নতুন একটা বিষয় ছিল, কারণ আমরা জানতাম না, সে কোথা থেকে এই টাকাটা পেয়েছে।
১৯৯৪ সালের এই ম্যাচটা নিয়ে কেউ চিন্তায় করেনি যে এখানে ম্যাচ ফিক্সিং হতে পারে। কেউ তো জানতোও না স্পট ফিক্সিং বলেও কিছু আছে। তারপর আমরা মাথা থেকে এসব বিষয় ঝেড়ে ফেললাম, এবং বললাম আমরা আগামিকাল ম্যাচটা জিততে চলেছি। তারপর আমরা বিয়ার খেতে চলে গেলাম।
বব সিম্পসন এসব বিষয় নিয়ে লিখে ম্যাচ রেফারিকে জানিয়ে দিলো। ম্যাচ রেফারি ছিলেন জন রিড সাবেক নিউজিল্যান্ড খেলোয়াড়। সে বললো, হলি শিট, এটা তো অনেক বড়ো খবর। এটার দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি দেখছি কি করা যায়। আমরা চিন্তা করে নিয়েছিলাম সে আইসিসিকে রিপোর্ট করেছিল, কিন্তু এ সম্বন্ধে আমরা আর তেমন কিছু শুনিনি।
ম্যাচটা শেষ দিন পর্যন্ত গড়িয়েছিল এবং এটা ছিল অন্যতম সেরা একটি টেস্ট ম্যাচ। মাঠে স্পিন ধরছিল এবং আমার কনফিডেন্স ততো বাড়তে ছিল।
যখন নবম উইকেটের পতন ঘটলো তখনও তাদের জয়ের জন্য ৫৬ রান দরকার ছিল। ইনজামাম উল হক তখনো ক্রিজে টিকে ছিলেন। ওপর প্রান্তে ছিলেন মুশতাক আহমেদ। যখন একটা বল তাঁর প্যাডে লাগলো আমরা ভাবলাম কাজ হয়ে গিছে আমরা জিতে গেছি। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে আম্পায়ার নট আউট ঘোষণা করে দিল।
শেষ দিকে সে ভালোই স্লগ করতে ছিল, তাদের দরকার ছিল ২০ রান আর আমাদের এক উইকেট। তখন আমি বোলিং করতে আসলাম। এখন একটু চিন্তা করেন, গতকালের অফারের কথা ২ লাখ ডলার, অফ- স্ট্যাম্পের বাইরে বল করতে হবে। একসময় পাকিস্তানের দরকার ৩ রান। হাতে আছে মাত্র ১ উইকেট।
আমি আমার বোলিংয়ে ফিল্ডিং পজিশন ভালো মতো সাজিয়ে নিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল লেগ ব্রেক করে আমি তার উইকেটটি নিবো। আমি ভাবতে লাগলাম এতো ঘটনার পর তাদের জয় পাওয়াটা উচিৎ নয়, জয়টা আমাদের প্রাপ্য। আমি বল করলাম সে ক্রিজ ছেড়ে এসে মারতে গেলো কিন্তু মিস করে বসলো। আমাদের কিপার ইয়ান হিলিও বলটা ধরতে পারলো না। এটা তার পায়ের ফাঁক দিয়ে চার হয়ে গেল। ম্যাচটা শেষ হয়ে গেল। আমরা হেরে গেলাম। পাকিস্তান অসম্ভব এক জয় তুলে নিল।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাকে ম্যাচ সেরা ঘোষণা করা হল। যখন আমি পোডিয়ামের কাছে যাচ্ছিলাম আমাকে সেলিম মালিকের পাশ দিয়ে যেতে হয়েছিল। তখন সে বলেছিল টাকাটা তোমার নেওয়া উচিৎ ছিল।
তখন আমার মনে হচ্ছিল আমি ঘুরে তার মুখে একটা ঘুসি মেরে বসি। কিন্তু কিভাবে যেন আমি নিজেকে কন্ট্রোল করেছিলাম।
আমি এই মুহূর্তটার কথা কোনদিন ভুলতে পারবো না।
_______________
নিজের আত্মজীবনী ‘নো-স্পিন’-এ এই ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন শেন ওয়ার্ন।