সৌরভ গাঙ্গুলির প্রথম সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সময়; লন্ডনে। ধনী বাবার এক বদরাগী, মেজাজি ছেলে হিসেবেই তখন গাঙ্গুলিকে জানতো সবাই। তাঁর প্রতিভার চেয়েও এই বিষয়গুলো নিয়েই বেশি আলোচনা হতো। তবে তাঁর সাথে সাক্ষাতে আমি ভিন্ন এক ইমেজ দেখেছি। খুবই ভদ্র, হাসি মুখ এবং অমায়িক ব্যবহারই দেখেছি তাঁর কাছে।
যদিও অনেকেই বলতো, সে সময় মতো আসে না। তবে একবার তাঁর সাথে কথা বললে তাকে অপছন্দের কোনো কারণই থাকবে না। লন্ডনে সেদিন সে খুব ভালো ব্যবহার দেখিয়েছিল। মাঠের ক্রিকেটে আগ্রাসী সেই অধিনায়ক মাঠের বাইরে খুবই ভদ্র একজন। বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফর্ম করে সেদিন বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল সৌরভ।
হোটেলের লবিতে যখন সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম তখন বেশ কিছু বাঙালি সাংবাদিকরাও ঘোরাঘুরি করছিল তাঁর কাছ থেকে কিছু জানার আশায়। অবশ্য সৌরভ বরাবরই বাঙালি সাংবাদিকদের আপন চোখেই দেখত। একজন ফ্রিল্যান্সার ফটোগ্রাফার ছিলেন যিনি রুম না পেলে সৌরভের রুমেই নিজের ব্যাগপত্র রাখতেন। মাঝে মাঝে রুমও শেয়ার করতেন। অনেকের মতেই সে ছিল সৌরভের খুব কাছের বন্ধু। এবং তাঁর কাছেই সৌরভ অনেক গোপন কথা শেয়ার করতো।
এত বাঙালী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তিনি বিরক্ত হন না কেন, জানতে চাওয়ার সাথে সাথেই বললেন, ‘কলকাতার বেহালায় তার বাড়ি সব সময়ই বন্ধু এবং কাছের মানুষদের জন্য খোলা থাকে। যে কেউই বড় সংখ্যায় হলেও বাবা-মার কাছে যেয়ে সৌরভের কৃতিত্বের জন্য অভিবাদন জানাতে পারে।’
গাঙ্গুলি বাঙ্গালী সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয়তাটা বোঝে এবং তাদের সংবাদপত্রের চাহিদাও জানে। কারণ নিজ রাজ্যেরই একজন ছেলে ভারতীয় ক্রিকেটে অসাধারণ পারফর্ম করছে। গাঙ্গুলি বলেন, ‘তাঁদের কিছু কোট দরকার হয়। আর আমি এটাকে বিরক্তিকর কিছু মনে করি না।’
সিনিয়র ক্রিকেটার অনিল কুম্বলের সাথে অনেকটা প্রতিযোগিতা করেই অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন সৌরভ। অবশ্য কুম্বলেও মনে করেছিলেন এটিই সঠিন সিদ্ধান্ত।
আমার মনে আছে হেডিংলিতে ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে জয়ের পর এক সাক্ষাৎকারে দ্রাবিড় বলেছিলেন, ‘টসে জিতে মেঘলা আকাশে সৌরভ ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। অবশ্য সঞ্জয় ব্যাঙ্গার ও রাহুল দ্রাবিড়ের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে প্রথম ইনিংসে বড় সংগ্রহ পায় ভারত। সৌরভ-শচীনরাও ভারতকে দারুণ শুরু এনে দিয়েছিল।’
আমি দ্রাবিড়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম সে কি আগে থেকেই অধিনায়ক হবার স্বপ্ন দেখেছিল? সে উত্তরে জানায়, ‘হ্যাঁ, অনেক ক্রিকেটারই সেই স্বপ্ন দেখে। আমিও দেখেছিলাম।’
দ্রাবিড় কখনোই বিতর্কিত কোনো মন্তব্য কিংবা পাব্লিকলি ভাইরাল হোক, এমন কোনো কিছু করতে চাননি। বেশ সতর্কতার সাথেই তিনি শব্দের ব্যবহার করতেন এবং প্রশ্নের জবাব দিতেন।
পরবর্তীতে এই আর্টিক্যাল যখন লিখা হচ্ছিল দ্রাবিড় আমার কাছে আসলো এবং বললো, ‘প্রদীপ, থামো!’ অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্নটা ফেলে দাও অনুগ্রহ করে। আমি তার অনুরোধটা রেখেছিলাম। অবশ্য তার উত্তরে ভুল কিছু ছিলো না। তবে তিনি চাননি তার উত্তর কোনোভাবেই গাঙ্গুলির অধিনায়কত্ব পাওয়া নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জিং কিছু হয়।
________________
জন রাইট খুব লম্বা আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির একজন মানুষ। সাংবাদিকদের কাছ থেকে অনেকটাই নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন তিনি। মাঠের জন রাইটস আর মাঠের বাইরের রাইটসের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ। আগের রাতে বিয়ার হাতে আপনার সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠা রাইটস পরের দিন মাঠে কড়া একজন শাসকের মতোই। তিনি সবসময়ই নিজের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল। উপযুক্ত পরিকল্পনা, অনুশীলনের শিডিউল, ডিসিপ্লিন সবকিছুই তিনি ঠিকঠাক করতে চাইতেন।
জন রাইট সে সময় বলেছিলেন, ‘আমি জানি ওরা অনেক বড় স্টার। ওদের ইগো আছে। আমি খুব বেশি নিয়মের মধ্যে রাখতে চাই না। যারা অনেক ভালো ক্রিকেটার বা তারকা তাদের ভুল আপনি চাইলেই বের করতে পারবেন না। আমি তাদের মানসিক অবস্থা বুঝেই কাজ করি। একটা আইডিয়া ধীরে ধীরে বাস্তবে রুপ দেই। আমি চাই ওরা ওদের লক্ষ্যটা বুঝতে পারুক। এখন পার্থক্য হলো ওরা বলে যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটা ওদের আইডিয়া। আমি কিছু মনে করি না কারণ আমি আমার লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি।’
ড্রেসিং রুমে করা পরিকল্পনার বিপরীত কাজটা মাঠে করলে রাইট বরাবরই চটতেন গাঙ্গুলির উপর। অধিনায়ক কথা না শোনায় রাইট চটলেও কখনোই দলের উপর নিজের রাগ ঝাড়তেন না। গাঙ্গুলি সব সময়ই কোচ এবং খেলোয়াড়ের মাঝে ভালো সম্পর্ক রাখতে চেষ্টা করতেন।
গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে জন রাইটসের তুলনা করতে যেয়ে গাঙ্গুলি বলেছিলেন, ‘এমনও দিন ছিল রাইট আমার উপর এতোটাই আপসেট থাকতো যে কথাই বলতো না। আমিও চুপ থাকতাম, আর সবকিছুই আবার স্বাভাবিক হয়ে যেত।’
গাঙ্গুলির প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ১৯৮৯-৯০ এর রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে। গাঙ্গুলি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ২২ রানের এক ইনিংস খেলেন। দুর্দান্ত সেই ম্যাচে দিল্লীকে হারিয়ে শিরোপা জেতে বাংলা দল। প্রথম ম্যাচ থেকে মাঠের ট্যাকটিকস নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি। কোন পরিকল্পনা কাজ করবে, কোনটা করবে না সেসব নিয়ে ভাবতেন তিনি। ড্রেসিং রুমের পরিকল্পনায় তিনি বিশ্বাস রাখতেন না। মাঠের খেলায় পরিস্থিতি বুঝেই পরিকল্পনা সাজাতেন তিনি।
এক টেস্টে হরভজন সিং খুব হতাশাজনক বোলিং করলো। এরপর ব্রেকের সময় কোচ এবং অধিনায়ক মিলে পরিকল্পনা করলো হরভজনকে অফ রেখে অন্য আরেকজন দিয়ে ওই প্রান্তে বোলিং করানো হবে। তবে মাঠে যাওয়ার পূর্বে গাঙ্গুলি দেখলো বেশ ভালো রিদমে হরভজন মাঠের একপ্রান্তে বল করছে। গাঙ্গুলি বলেন, ‘যখন ম্যাচ শুরু হলো পরিকল্পনার বিপরীতে গিয়ে আবার আমি হরভজনকে বল দিলাম। এবং সে দ্রুতই উইকেট এনে দেয়!’
তিনি বলেন, ‘কোচ হয়তো তখন আপসেট হয়। আসলে ফলাফল তো কখনোই আপনার হাতে নয়।’
২০০৩ অ্যাডিলেড টেস্টে গাঙ্গুলি-রাইট কম্বিনেশন ছিল। ২৩০ রান তাড়া করে যেখানে ঐতিহাসিক জয় তুলে নেয় ভারত। ৪র্থ দিন শেষে ভারতের তখনো দরকার ছিল ১৯৩ রানের। সন্ধায় দ্রাবিড় তখন গাঙ্গুলির রুমে গেলো। ম্যাচের প্রেশারটা হয়তো কাটিয়ে উঠতেই আলোচনা ছিল। সেই জয়ে ৪৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেছিলেন বীরেন্দ্র সেওয়াগ। তবে দ্রাবিড়ে হার না মানা ৭২ রানের ইনিংসেই জয় পায় ভারত। ৪১ মিনিট ক্রিজে থেকে গাঙ্গুলি খেলেছিলেন ১২ রানের ইনিংস।
জয়ের পর গাঙ্গুলি তখন বেশ উচ্ছ্বসিতই ছিল। যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম যে কিভাবে এই চাপ কাটালো? তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমি যখন ব্যাট করছিলাম, আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম! বল দেখতেও কষ্ট হচ্ছিল।’
দ্রাবিড়কে এই কথা বলেওছিলেন তিনি। আর ডেপুটির এমন অসাধারণ ইনিংসে গাঙ্গুলি অবশ্য বড্ড খুশি ছিলেন।
অসাধারণ এক জয়ের পরেও সেওয়াগের বাজে আউটে হতাশ ছিলেন রাইট। দলের গুরুত্বপূর্ণ মোমেন্টে উইকেট গিফট করে আসায় জয়ের চেয়েও ক্ষোভটা বেশি ছিল রাইটের। রাইট মানুষটা এমন ছিল যে তাঁর কাছে শৃঙ্খলাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গাঙ্গুলির উপর বিভিন্ন সময় চটলেও আবার তা স্বাভাবিক হতো সময়ের ব্যবধানেই।
________________
মূল লেখাটি The many multitudes of Sourav Ganguly প্রকাশিত হয়েছে ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে।