২০০০ সালের ঘটনা।
ম্যারাডোনার আত্মজীবনী বের হল। সারা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দেওয়া এই বইটা থেকে আসছে হাজার হাজার ডলার।
সে সময় ম্যারাডোনার টাকারও দরকার। কোকেন, হার্ট অ্যাটাক, স্থুলতা মিলিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছেন তখন প্রায়। এমন সময়ে দাড়িয়ে ম্যারাডোনা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই বইটার কিউবান সংষ্করণ থেকে কোনো টাকা তিনি রয়্যালিটি হিসেবে নেবেন না।
কারণ, এটা তিনি তার বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর সম্মান কিউবার সকল মানুষকে উৎসর্গ করছেন।
ম্যারাডোনা বলতেন, বন্ধু। ইংরেজীতে ওটাই জুৎসই শব্দ। কিন্তু সম্পর্ক ছিলো পিতাপূত্রের মতো। নিয়তির কী অপূর্ব খেলা!
২০১৬ সালের এই ২৫ নভেম্বর পিতৃতূল্য গুরু ফিদেল এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। চার বছর পর ঠিক সেই দিনটাকেই দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য বেছে নিলেন সেই ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনা এমনই। তার কাছে যে ফুটবলের চেয়ে এই মানুষের জন্য রাজনীতি বা লাতিন বামপন্থা অনেক বড় ব্যাপার।
ম্যারাডোনা যখন কিছুতেই নেশার কবল থেকে বের হতে পারছিলেন না, এই ক্যাস্ট্রোই তাকে কিউবায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। যখন হার্ট এটাক করলেন, হৃদযন্ত্রে জটিল সমস্যা ধরা পড়লো; ম্যারাডোনা মারা গেছেন বলেই খবর বের হয়েছিলো। এই ক্যাস্ট্রো পাশে থেকেছেন চিকিৎসার প্রতিটি পদক্ষেপে।
ব্যক্তিগতভাবে ম্যারাডোনা ক্যাস্ট্রোদের রাজনৈতিক পথের অনুসারী ছিলেন।
ঘোরতর আমেরিকা বিরোধী ছিলেন। হুগো শ্যাভেজ, ইভো মোরালেসদের সাথে মিলে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও অংশ নিয়েছেন। জর্জ বুশের সাথে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
স্মৃতি প্রতারণা না করলে জর্জ বুশের কন্যারা একবার গিয়েছিলেন বোকা জুনিয়র্সের আমন্ত্রনে আর্জেন্টিনায়। তাদের বোকার জার্সি পরানো হয়েছিলো। ম্যারাডোনা ছিলেন বোকা জুনিয়র্সের আজীবন সমর্থক। ক্লাবটি বুশ কন্যাদের এভাবে সম্মানিত করায় তিনি খুব চটেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যাদের বাবার হাতে মানুষের রক্ত মাখা, তাদের এই সম্মান প্রাপ্য না।’
নিজে মুখে বলেছেন, ‘আমি শ্যাভেজের অনুসারী, আমি রাউলের অনুসারী। আমার বন্ধু ফিদেল যা বলবেন, আমি সেই মতের অনুসারী।’
ম্যারাডোনার লাতিন বামপন্থা, তথা এই এলাকার রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা ফুটবলের চেয়ে বড়। এটা বুঝতে একটা ঘটনা মনে করতে পারেন। বলিভিয়ার লা পাজের কথা তো জানেন। অতি উচ্চতার এই ভেন্যুতে খেলতে গেলে বাইরের সব খেলোয়াড়ের শ্বাসকষ্ট হয়। এটা বিবেচনায় নিয়ে ফিফা একবার এই অতি উচ্চতার ভেন্যুগুলোকে নিষিদ্ধ করলো।
লা পাজে খেলতে গিয়ে সবচেয়ে বিপাকে পড়ে লাতিন আমেরিকান বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে এই অঞ্চলের দেশগুলো। মজার ব্যাপার হলো, এর বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকাতেই ফিফার এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ হলো।
ম্যারাডোনা রীতিমতো ইভো মোরালেসদের সাথে এই বয়সে লা পাজে গিয়ে এক ঘণ্টা ফুটবল খেললেন। এই প্রতিবাদ আমলে নিয়ে ফিফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলো।
গল্পটা এখানে শেষ নয়।
২০১০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে এই লা পাজে গেলো আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা তখন কোচ। আর্জেন্টিনা ৬-১ গোলে হারলো। ম্যারাডোনাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘এখন কী মনে হচ্ছে, লা পাজের পক্ষে দাড়িয়ে ভুল করেছিলেন?’
ম্যারাডোনা চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘বলিভিয়া বেটার ফুটবল খেলেছে। আমরা জঘন্য খেলেছি। ভালো খেললে যে কোনো জায়গায় ওরা জিততে পারে। লা পাজ কোনো অজুহাত হতে পারে না।’
এভাবেই তিনি বিপ্লবীদের, বামপন্থীদের পাশে ছিলেন।
২০১৫ সালের কথা। হঠাৎ খবর রটে গেলো, ফিদেল ক্যাস্ট্রো মারা গেছেন। ইউরোপিয়ান সংবাদ মাধ্যমগুলো ফোন করলো ম্যারাডোনাকে। তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘আমার সাথে একটু আগে কথা হয়েছে। তার মানে, ফিদেলের মৃত্যুসংবাদ একটু অতিরঞ্জিত। ফিদেলের কাজ আছে। সে এখনই মারা যাবে না।’
এই হলেন ম্যারাডোনা।
তার হাতে চে গুয়েভারার উল্কি। পায়ে ফিদেল কাস্ত্রোর প্রতিকৃতি। আর মুখে চুরুট। তিনি নিজেকে ফিদেলের সৈনিক বলেই দাবী করতেন। এবার তিনি নেতার পথে নেতার সাথেই চলে গেলেন।