নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল। জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার ২ বলে ৬ রান। স্ট্রাইকে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ইসুরু উদানার লেগ স্টাম্পের উপর করা ফুলার লেন্থের বল ডিপ স্কোয়ার লেগ দিয়ে ছক্কা হাঁকালেন রিয়াদ! দুর্দান্ত এক জয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।
সেই নিদাহাস ট্রফির কথা মনে আসলেই বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকদের চোখে ভেসে ওঠে ইসুরু উদানার বলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মারা সেই ছক্কাটি! একদিকে রিয়াদ-রুবেলদের উদযাপন আরেকদিকে ক্রিজে মূর্তিমান বসে থাকা উদানার নির্বাক চোখে হারের কষ্টটা স্পষ্ট ভেসে উঠছিল।
ডেথ ওভার স্পেশালিষ্ট হিসেবে পরিচত সেই লঙ্কান পেসার ইসুরু উদানা সদ্যই ঘোষণা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর। ৩৩ বছর বয়সেই হুট করে ক্যারিয়ারে ইতি টানার ঘোষণা দিয়েছেন এই বাঁ-হাতি পেসার। চরম অধারাবাহিক ক্যারিয়ারে উত্থান কম; পতনটাই তিনি বেশি দেখেছেন।
ছোটবেলায় ক্রিকেট থেকে ফুটবলটাকেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। হতে চেয়েছিলেন একজন অ্যাথলেট। লং জাম্পে ছিলেন বেশ দুর্দান্ত। অবশ্য তাঁর স্কুলে মাত্র একজন কোচই ছিলেন। যিনি ক্রিকেট, অ্যাথলেট সহ প্রায় সব খেলারই কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন!
শ্রীলঙ্কায় ক্রিকেটের অনেক সুযোগ সুবিধা থাকলেও অ্যাথলেটদের জন্য তেমন কিছুই ছিল না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ক্রিকেটকেই বেছে নেন তিনি। ১৩ বছর বয়স থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন উদানা। উদানা স্পোর্টস ফ্যামিলি থেকেই উঠে এসেছিলেন। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বড় ভাই ছিলেন দেশ সেরা ‘জাভেলিন থ্রোয়ার’।
শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে বেশ দূরের এক গ্রাম বালানগোডায় জন্মগ্রহণ করেন ইসুরু উদানা। শ্রীলঙ্কায় স্কুল ক্রিকেটের অবকাঠামো তখন বেশ ভালো ছিল। অনূর্ধ্ব-১১ থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যন্ত সব বয়সভিত্তিক দলই ছিল সেখানে। অনূর্ধ্ব-১৩ থেকেই ক্রিকেটে পদচারণার শুরু হয় উদানার। নিজ গ্রামের স্কুল দলের হয়েই খেলতেন তিনি। অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যন্ত সেখানেই ক্রিকেট খেলেন তিনি। এরপর সেখান থেকে স্কলারশিপ নিয়ে চলে আসেন কলম্বোতে। আর সেখান থেকেই ক্যারিয়ারে এক নতুন যাত্রা শুরু করেন তিনি।
তখন প্রায় ২০ বছর বয়স তাঁর। স্কুলের পর অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে খেলতে যেতেন তিনি। একবার শ্রীলঙ্কার একটা পেস অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার সুযোগ হয় তাঁর। ওই সময় শ্রীলঙ্কা এ দলের দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে একটা লম্বা সফর ছিল। অনূর্ধ্ব-১৮ দলেরও তখন একটা সিরিজ ছিল। সেটিকে সামনে রেখেই অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন চলছিল। সেই একাডেমিতে অনূর্ধ্ব-১৮ দলের বিপক্ষে বেশ কয়েক ওভার বল করেন তিনি। আর তাতেই মুগ্ধ হয়ে যান সেখানকার কোচ। এরপর উদানাকে ট্রায়াল ম্যাচে খেলার সুযোগ করে দিলেন তিনি।
ট্রায়াল ম্যাচগুলোতে ভালো পারফর্ম করে জায়গা করে নেন শ্রীলঙ্কা এ দলের স্ট্যান্ডবাই লিস্টে। অবশ্য পেসার ধামিকা প্রসাদের ইনজুরিতে কপাল খুলে যায় তাঁর। সুযোগ পেয়ে গেলেন মূল দলে। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কা এ দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষিক্ত হন তিনি। কোনো ক্লাবের হয়ে খেলার আগেই স্কুল ক্রিকেট থেকে সরাসরি সুযোগ পেয়ে যান শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলে! সুযোগ পেয়ে বেশ ভালো পারফর্ম করেন সেখানে। সেখান থেকেই সরাসরি সুযোগ পেয়ে যান জাতীয় দলে!
শহর থেকেও বেশ দূরের এক গ্রাম থেকে জাতীয় দলে উঠে আসার জার্নিটা মোটেও সহজ ছিল না উদানার জন্য। তাও কিনা স্কুল ক্রিকেটের গণ্ডি পেরোবার আগেই লঙ্কানদের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর কলম্বোতে এসে একা ছয় বছর কাটানোর পর ঝামেলা এড়াতে পরিবারকেও সাথে নিয়ে আসেন তিনি। এরই মাঝে নিজেকে মেলে ধরেন ক্লাব ক্রিকেটে।
২০০৮ সালেই সুযোগ পেয়ে যান তামিল ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে খেলার। এরপর সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার আন্ত:অঞ্চল ভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পান তিনি। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে বাশনাহিরা সাউথের বিপক্ষে ৩১ রানে ৪ উইকেট শিকার করে দলকে শিরোপা জেতান উদানা। সেই সাথে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জেতেন তিনি।
স্কুল ক্রিকেট থেকে উঠে আসা এই পেসার তখন পেস বলতে শুধু জানতেন বল নিয়ে দৌঁড়ে ব্যাটসম্যানদের সামনে ফেলতে হবে। ইনস্যুইং, আউটস্যুইং কিংবা স্লোয়ার এসব ব্যাপারে তিনি ছিলেন অজ্ঞ! ২০০৮ সালে সেই আন্তঃঅঞ্চল ভিত্তিক টুর্নামেন্টে নেটে উপুল থারাঙ্গাকে ভিন্ন এক ডেলিভারিতে আউট করে রপ্ত করেছিলেন স্লোয়ার ডেলিভারি! এরপর টানা অনুশীলন করে স্লোয়ার ডেলিভারিকে নিজের মূল অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন এই পেসার।
ঘরোয়া ক্রিকেটে নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স দিয়ে ইসুরু উদানা জায়গা করে নেন ২০০৯ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে লঙ্কান স্কোয়াডে। জাতীয় দলে কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়বর্ধন, সনাথ জয়সুরিয়াদের মতো তারকাদের পেয়ে ভালো করার স্পৃহাটা আরো বেড়ে যায় উদানার। তবে জাতীয় দলে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট তিনি পেয়েছিলেন মাহেলা জয়াবর্ধনের কাছ থেকে – যা এক সাক্ষাৎকারে অকপটে শিকার করেন তিনি। যদিও তাঁর পছন্দের বোলার ছিলেন আরেক লঙ্কান তারকা লাসিথ মালিঙ্গা।
৮ জুন ২০০৯। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদচারণা শুরু করেন উদানা। অভিষেক ম্যাচে ৪ ওভারে ৪৭ রানে দিয়ে শিকার করেন দুই উইকেট। ওই টুর্নামেন্টে ৫ ম্যাচে ৯+ ইকোনমিতে ৫ উইকেট শিকার করেন উদানা।
এমন হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। তিন বছর পর ২০১২ সালে আবারো দলে সুযোগ পান উদানা।পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ফিরেই ৪ ওভারে মাত্র ১৮ রান দেন, ছিলেন উইকেটশূন্য। এমন ইকোনমিক পারফরম্যান্সের পরেও আর সুযোগ পাননি তিনি! পরের চার বছর জাতীয় দলের মুখই দেখেননি উদানা।
অবশ্য তার এক মাস বাদেই ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় উদানার। আর অদ্ভুতভাবেই দুই ম্যাচে ৬ ওভার বল করে ৪২ রান দিয়ে (ম্যাচ প্রতি) কোনো উইকেটই শিকার করতে পারেননি তিনি! টি-টোয়েন্টির পর ওয়ানডে দল থেকেও বাদ পড়লেন তিনি।
এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে অনবদ্য পারফরম্যান্সের চার বছর পর টি-টোয়েন্টিতে ফিরলেও ওয়ানডেতে সুযোগ পাননি তিনি। ২০১৬ সালে মাত্র এক ম্যাচ খেলেই আবারো এক বছরের জন্য দলের বাইরে তিনি! অভিষেকের পর ৭ বছরে মাত্র ৯ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। এর মূল কারণ ছিল জাতীয় দলে নিজেকে মেলে ধরতে না পারা! অবশ্য একটানা সুযোগও পাননি তিনি।
২০১৭ সালে দলে ফিরে কিছুটা নিয়মিত হন উদানা। ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত খেলেন ২৮ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। এর মাঝে সাত বছর পর ২০১৯ সালে ওয়ানডেতে কামব্যাক করেন তিনি! ওই বছর ১৩ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। ২০১৯ সালেই ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেন তিনি। অবশ্য লঙ্কান দলে তখন ভঙ্গুর অবস্থা। বাজে পারফরম্যান্স আর টানা ম্যাচ হারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল লঙ্কান ক্রিকেট।
টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা থেকে রঙিন পোশাকে লঙ্কানদের নিয়মিত মুখ হয়ে উঠছিলেন তিনি। এরপরই করোনার হানা! গেল বছর তিন টি-টোয়েন্টি আর তিন ওয়ানডেসহ খেলেছেন মাত্র ৬ ম্যাচ। আর চলতি বছর খেলেছেন ৮ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তবে বল হাতে সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি উদানা। ৩৫ টি-টোয়েন্টি আর ২১ ওয়ানডেতেই ক্যারিয়ারে ইতি টানেন এই পেস অলরাউন্ডার।
এক টুর্নামেন্টে মহেন্দ্র সিং ধোনির থেকে পাওয়া একটি ব্যাট ছিল তারই কোনো সতীর্থ খেলোয়াড়ের কাছে। সেটি নেওয়ার জন্য সেই খেলোয়াড়কে দু’টি ব্যাটের অফার দেন তিনি। অন্যান্য ব্যাটের তুলনায় সেটি একটু ভিন্নই ছিল। এরপর ওই ব্যাট হাতে অনেক রানও করেন উদানা। সেখান থেকেই ব্যাট হাতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন তিনি।
বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও তার হিটিং অ্যাবিলিটি ছিল অসাধারণ। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে উদানার ক্যারিয়ারে লাকি চার্ম হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্লাব ক্রিকেট না খেলে সরাসরি দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে সুযোগ। এরপর ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথমে ওয়ানডেতে ১৩৭ স্ট্রাইক রেটে ৫৭ বলে ৭৮ রানে দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন।
এরপর একই সফরে টি-টোয়েন্টিতে ১৭৫ স্ট্রাইক রেটে ৪৮ বলে ৮৪ রানের এক দাপুটে ইনিংস খেলেন তিনি। ওই ম্যাচে আট নম্বরে ব্যাটিং করে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন তিনি! দুই ম্যাচেই দলের ব্যাটিং ব্যর্থতার দিনে একাই লড়াই করেন উদানা! তবে দুই ম্যাচেই হার নিয়ে মাঠ ছাড়ে লঙ্কানরা। ক্যারিয়ার শুরু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ওয়ানডেতে একমাত্র ফিফটি সেটিও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এবং টি-টোয়েন্টির একমাত্র ফিফটিও তাদেরই বিপক্ষে!
২০১০ চ্যাম্পিয়নস লিগ টি-টোয়েন্টিতে তিনি প্রথম বোলার হিসেবে হ্যাট্রিকের কীর্তি গড়েন। দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথে তার হ্যাট্রিকে বড় জয় তুলে নেয় ওয়াম্বা ইলেভেন।
উদানা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) সহ বেশ কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে খেলেছেন। ২০২০ আইপিএল আসরের নিলাম চলছিল। প্রথম ডাকে উদানা অবিক্রীত ছিলেন! এরপর তিনি টিভি বন্ধ করে অন্য কাজে চলে যান।
পরবর্তীতে যখন তাকে আবার নিলামে তোলা হয় এবং রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু তাকে দলে কিনে নেয়; তাঁর পরিবার তাকে ফোন করে এবং জানান তিনি আইপিএলে দল পেয়েছেন। উদানা নিজেও বিশ্বাস করতে পারেননি যে তিনি শেষ পর্যন্ত দল পাবেন!
অধারাবাহিক ক্যারিয়ারে বিতর্ক বলতে ২০১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এমজানসি সুপার লিগের (এমএসএল) ফাইনালে এক ভুল বুঝাবুঝিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওই ম্যাচে ২৪ রানে ২ উইকেট নিয়ে তাঁর দল পার্ল রকসকে শিরোপা জেতাতে সাহায্য করেন উদানা।
ম্যাচ চলাকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার এক দর্শক ‘ম্যারি মি উদানা’ প্ল্যাকার্ড হাতে উঁচিয়ে ধরেন। যা নজর এড়ায়নি উদানার। তিনি হাসি মুখে মিডল ফিঙ্গার (রিং পরিহিত) দেখিয়ে সেই ভক্তকে বোঝাতে চান যে তিনি বিবাহিত। তবে সেটির নেতিবাচক অর্থ বের করে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুটা ট্রলের শিকার হন উদানা। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি এই ব্যাপার পরিষ্কার করেন।
ক্রিকেট মাঠে ‘ইজি’ নামে খ্যাত উদানার ক্যারিয়ারটা ছিল চরম অধারাবাহিক। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করলেও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। তাই পুরো ক্যারিয়ারে দলে আসা যাওয়ার ভেতরেই কেটেছে তাঁর। ১২ বছরের দীর্ঘ সময়ের ক্যারিয়ারে মোটে ৫৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচই প্রমাণ করে জাতীয় দলে তাঁর ব্যর্থতা।