লিওনেল মেসি, যেদিন বার্সেলোনা ছেড়ে গেলেন সেদিন অঝোরে কেঁদেছিলেন। ফুটবল বহুবার এমন দৃশ্যের মঞ্চায়ন করেছে। একটা ক্লাবের সাথে জুড়ে থাকার স্মৃতি যেন ক্ষণিকের জন্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তেমন এক সময় পার করেছিলেন ইংলিশ কিংবদন্তি ফুটবলার মাইকেল ওয়েন। তাঁর সময়ে বাঘা-বাঘা সব তারকাদের ভিড়ে তিনি ছিলেন অনন্য এক চরিত্র। থিয়েরি ওঁরি, জিনেদিন জিদান, লুইস ফিগো, রাউল, ডেভিড বেকহ্যামদের মত খেলোয়াড়দের পেছনে ফেলে ব্যালন ডি’অরের সে স্বর্ণালী বলটা নিজের করে নিয়েছিলেন এই স্ট্রাইকার।
তাঁর এই উত্থানের শুরু মার্শিসাইড ক্লাব লিভারপুলে। অলরেডদের হয়েই তিনি ক্রমাগত একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েছেন তিনি। আনফিল্ড তো ছিল তাঁর আরেক ঘর। নিজ গৃহ ছেড়ে যেতে পরাণ কাঁদবে। সে বেদনার অশ্রু চোখ গড়িয়ে চিবুক হয়ে পড়বে সবুজ ঘাসে। রিয়াল মাদ্রিদে যাবার সুযোগ পাওয়ার পর এমনটাই হয়েছিল ওয়েনের সাথে।
২০০৪ সালে মাদ্রিদের অফার আসে তাঁর জন্য। রিয়াল মাদ্রিদ বরাবরই ইউরোপের ফুটবলে বিশাল বড় এক ‘ফ্যাক্টর’। ঐতিহ্য আর অর্জনে ঠাসা ক্লাবটায় কে বা না যেতে চায়। এই যেমন অরেলিয়ান চৌমেনিই হতে পারেন আরেক উদাহরণ। তরুণ এই ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ডারের জন্য বেশ অর্থ কড়ির পসরা নিয়ে হাজির হয়েছিল ফ্রান্সের ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই।
অর্থের সে প্রলোভনকে দূরে ঠেলে দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে জড়ানোর সিদ্ধান্তটাই নিয়েছেন তিনি। রিয়ালের রাজকীয় সেই সাদা জার্সিটা গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন সবাই দেখে নিশ্চয়ই। তাইতো ওয়েন পড়ে গিয়েছিলেন দোটানায়। তিনি ভাবছিলেন। তিনি তাঁর শৈশবের ক্লাব ছেড়ে যাবেন নতুন এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে, নাকি থেকে যাবেন? কিন্তু, অন্যদিকের ক্লাবটা তো রিয়াল মাদ্রিদ।
রিয়াল মাদ্রিদ তখন তারকায় পরিপূর্ণ। ডেভিড বেকহ্যাম, রাউল, রবার্তো কার্লোস, লুইস ফিগো, জিনেদিন জিদানদের মত তারকাদের নিয়ে তখন ‘গ্যালাক্টিকোস’ রিয়াল মাদ্রিদ। সেখানটায় গিয়ে ওয়েনের একাদশে সুযোগ পাওয়াটাও ছিল একটা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। ওয়েন সেটা জানতেন। তাইতো তিনি মাদ্রিদের প্রস্তাবের উত্তরের আগের সপ্তাহ কাটিয়েছেন নির্ঘুম প্রহর গুণে।
এ বিষয়ে ওয়েন বলেন, ‘আমি সপ্তাহ খানেক ঘুমোতে পারিনি। এমনকি আমার এটা বলতেও লজ্জা নেই যে আমি গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট যাওয়ার সময় কেঁদেছি।’
ঠিক এমন এক পরিস্থিতি পার করেই মাইকেল ওয়েন গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড ছেড়ে স্পেনে। দোটানায় কাটানো প্রহর নিয়ে ওয়েন বলেন, ‘আমি একটা সময় ভেবেছি সবকিছু ছেড়ে রয়ে যাব লিভারপুলেই। আবার পরক্ষণেই মাথায় চিন্তা এসেছে রিয়াল মাদ্রিদের মত একটা ক্লাবের প্রস্তাব ছেড়ে দেব?’
তবে নতুন এক অভিজ্ঞতার সুযোগ আর রিয়াল মাদ্রিদের ব্যাজটি গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে মাদ্রিদে যেতে বাধ্য করে। তবে তিনি একটা মৌখিক চুক্তি করে রাখেন। যেন তিনি আবার ফেরত আসতে পারেন লিভারপুলে। তবে তেমনটা আর হয়নি। ক্যারিয়ারে তিনি আর ফেরত আসতে পারেননি লিভারপুলে। সে নিশ্চয়ই ভিন্ন গল্প।
তবে মাদ্রিদে গিয়ে নিজেকে প্রমাণের ইচ্ছেটা ছিল তাঁর। ওয়েন নিজেকে প্রমাণের কোন সুযোগই যেন হাতছাড়া করতে চাইতেন না। সুযোগ যখনই পেয়েছেন তিনি সতীর্থদের সমীহ আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেননা তাঁর প্রতিপক্ষরাই তো একেকজন বিশাল বড় তারকা।
তবে ‘অ্যাডভেঞ্চার’ যাত্রাটা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি। মৌসুমের মাথায় তাঁর ডাক আসে ইংল্যান্ড থেকে। নিউক্যাসেল ইউনাইটেড তাকে দলে নেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলে। মাদ্রিদ তার কোর্টে বল দিয়ে বলেছিল সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে। বিশ্বকাপের কথা এবং যথাযথ খেলার সময় না পাওয়া এই দুই মিলিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে আবার ফিরে যাবেন ইংল্যান্ডে।
মাত্র এক মৌসুমের মাথায় ওয়েনের মত বিশ্বমানের এক স্ট্রাইকারের রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ার থমকে যায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে ফেলে আসে শৈশবের সে স্মৃতিগুলো বাকিটা সময় ওয়েনের অবসর সময় কাটানোর খোরাক হয়েই রয়ে যায়। তবে তিনি লিভারপুলের ইতিহাসে চির সবুজ, না, চির লাল হয়ে রয়ে যান।