বাল্টিমোর বুলেট, ফ্লাইং ফিশ, গোমার পাইল।
যে কোনো নামে ডাকতে পারেন। আপনার পছন্দ মতো যেকোনো আদরের বিশেষন বসিয়েও দিতে পারেন। তবে একটা বিশেষন এখন উচ্চারণ করতেই হবে-সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান।
তবে সেরা কথাটা হলো, এই কালের লিওনিডাস হলেন মাইকেল ফেলপস।
লিওনিডাসকে প্রাচীন ঐতিহাসিকেরা বলতেন, সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান। ১২টি ব্যক্তিগত ইভেন্টে শ্রেষ্ঠ ছিলেন তিনি। সেই রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছেন মাইকেল ফেলপস। ইতিহাসকে আবার তুলে এনে নিজের করে নিয়েছেন। যেনো এ কালের এক গ্রীক অ্যাথলেটের নাম ফেলপস।
২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে ৮টি সোনা জেতার বছর দুয়েকের পরই সুর উঠেছিলো, ফেলপস ফুরিয়ে গেছেন। নেশা করে, বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করে নিজেই সুরটা তুলে দিয়েছিলেন। ২০১২ অলিম্পিকে সেখান থেকে ফিরে এসে জিতলেন আরও চারটি সোনা। এবার আর নেশা করতে হলো না। বয়সটা বেড়ে গিয়েছিলো, ফর্মও যাচ্ছেতাই। ফেলপস নিজেই অবসর নিয়ে নিলেন; বললেন-আমি ফুরিয়ে গেছি।
অথচ, কী ভুতুড়ে কান্ড! বেড়াতে আসার মতো করে এসে রিও অলিম্পিকে ঝুলিতে পুরে ফেলেন আরও ৫টি সোনা। সবমিলিয়ে ২৩টি ব্যক্তিগত স্বর্ন; ২৮টি অলিম্পিক পদক! অবিশ্বাস্য বললেও একটু কম বলা হয়।
সিডনিতে ২০০ মিটার ফ্লাই দিয়েই নিজের অলিম্পিক যাত্রা শুরু করেছিলেন ফেলপস। ২০০৪ এথেন্স এবং ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতলেও ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে হেরে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান সাঁতারু চাদ লে ক্লসের কাছে।
মোট ২৮টি মেডেল, ২৩টি মোট সোনা, ১৬টি ব্যক্তিগত সোনা, ১২ বছর ধরে অলিম্পিকে পদক জিততে থাকা, টানা চার অলিম্পিকে কোনো না কোনো ইভেন্টে সোনা, এক অলিম্পিকের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সোনা, এক গাদা বিশ^রেকর্ড; এই কয়েকটা তথ্যই যথেষ্ঠ ফেলপসকে সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান বলে স্বীকৃতি দিতে।
এরপরও কেউ কেউ নিক্তিতে মেপে দেখার চেষ্টা করছেন যে কার্ল লুইস, পাভো নুরমি, লারিসা লাতানিনা বা এই যে উসাইন বোল্ট; এরা কেউ কী এখনও মাইকেল ফেলপসের চেয়ে বড় স্বীকৃতির দাবিদার? এটা ঠিক যে, বোল্ট, লুইসরা চাইলেও একটা অলিম্পিকে ৮টা সোনা বা চারটে অলিম্পিকে ২১টা সোনা জিততে পারবেন না; অতো ইভেন্টই নেই তাদের খেলাতে।
এটাও সত্যি যে কার্ল লুইসের মতো বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তৃত নয় ফেলপসের দাপট। এটাও ঠিক যে পাভো নুরমি বা লারিসা লাতানিনার মতো প্রভাবও নয় ফেলপসের। এটাও সত্যি যে, বোল্টের মতো ফেলপস নিজের খেলাটাকে বাকীদের ধরাছোয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি রেস চলাকালে।
তবে সব সত্যির বড় সত্যি হলো অর্জনÑ২৩টা সোনা কিংবা ১৬টা ব্যক্তিগত সোনা অর্জন। আর এই অর্জনে ম্লান হয়ে যায় সব তর্ক।
তারপরও একজন ছিলেনÑলিওনিডাস অব রোডস। প্রাচীন অলিম্পিকের এই দৌড়বিদকে এবারের অলিম্পিকের আগ পর্যন্ত বলা হতো সর্বকালের সেরা অলিম্পিয়ান। ১৬৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে ১৫২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টানা চারটি অলিম্পিকে ৩টি করে মোট ১২টি ব্যক্তিগত ইভেন্টের শ্রেষ্ঠত্ব ছিলো লিওনিডাসের দখলে।
ইতিহাসকে সত্যি বলে বিবেচনায় নিলে মানতে হবে, এবারের রিও অলিম্পিক শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অলিম্পিয়ান ছিলেন এই লিওনিডাস। আজকের উসাইন বোল্ট নন, অসীম বৈচিত্রশীল কার্ল লুইস নন; শেষ পর্যন্ত গতকাল এসে সেই লিওনিডাসকে স্পর্শ করলেন মাইকেল ফেলপস নামের জলদানবই।
২১৬৮ বছর পর অবশেষে সেই লিওনিডাসকেও স্পর্শ করলেন ফেলপস।
এই ফাঁকে লিওনিডাসের গল্প একটু শুনে নেওয়া যাক। লিওনিডাস ছিলেন গ্রীসের রোডস শহরের মানুষ। সে কালে লোকেদের যেভাবে চিহ্নিত করা হতো, সেই রীতি অনুযায়ীই গ্রীসের প্রাচীন অলিম্পিকে তাকে উল্লেখ করা হতো ‘লিওনিডাস অব রোডস’ বা রোডস শহরের লিওনিডাস নামে।
বিশিষ্ট গ্রীক দার্শনিক ও অলিম্পিক ঐতিহাসিক লুসিয়াস ফ্লাবিয়াস ফিলোস্ত্রাতাস বা ফিলোস্ত্রাতাস অব এনথেনিয়ান্স তার বিখ্যাত ‘জিমন্যাস্টিকোস’ নামে বইয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছেন লিওনিডাসের এই ১২ বছর মেয়াদী সাফল্যের গল্প। আনুমানিক ২২০ সালে লেখা এই বইয়ে ফিলোস্ত্রাতাস বলেছেন, সেকালের সবচেয়ে বহুমুখী অ্যাথলেট ছিলেন রোডস শহরের লিওনিডাস।
এই স্বাক্ষ্য অনুযায়ী ১৬৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ প্রথম অলিম্পিকে অংশ নেন লিওনিডাস। প্রথম আসরেই জিতে নেন স্ট্যাডিয়ন, ডিয়াউলোস এবং হপলিটোড্রোমোস নামে তিনটি প্রতিযোগিতা। এই তিন প্রতিযোগিতায় পরের তিনটি অলিম্পিকেও শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখেন লিওনিডাস।
এই তিনটি ইভেন্টের পরিচয় জানলে বুঝতে পারবেন, কী বৈচিত্রপূর্ণ ছিলো লিওনিডাসের ক্ষমতা।
স্ট্যাডিয়ন ও ডিয়াউলোস ছিলো সেকালের স্প্রিন্ট; যথাক্রমে ২০০ গজ ও ৪০০ গজের দৌড়। অন্য দিকে হপলিটোড্রোমোস ছিলো একটা ৪০০ গজের দৌড় যাতে অংশ নিতে হতো ব্রোঞ্জের তৈরী বর্ম, শিরস্ত্রান পরে এবং ধাতব অস্ত্র হাতে নিয়ে।
ফিলোস্ত্রাতাস লিখেছেন, প্রথম দুটি ইভেন্টে অংশ নিতো মূলত সে কালের ক্ষিপ্রতম লোকেরা। অন্যদিকে তৃতীয় ইভেন্টটা ছিলো পেশীবহুল মল্লাযোদ্ধাদের দাপট দেখানোর জায়গা। কারণ এই ইভেন্টে ক্ষিপ্রতার চেয়ে বড় ব্যাপার ছিলো ভয়ানক ওজনদার এই পোশাক ও অস্ত্র নিয়ে দৌড়ানোর মতো শারীরিক শক্তি থাকাটা।
লিওনিডাসের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলতে গিয়ে ফিলোস্ত্রাতাস বলেছেন, এই কীর্তিমান অ্যাথলেট কেবল ১২ বার ব্যক্তিগত ইভেন্টে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন, তা নয়। তিনি আসলে প্রথমবারের মতো অ্যাথলেটদের ট্রেনিং নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করেছেন সেকালের গ্রীসকে।
আগে যেমন লোকেরা কেবলই পেশি বাড়ানো অথবা কেবলই গতি বাড়ানো নিয়ে ভাবতো, লিওনিডাসের সাফল্যের ফলে গ্রীসে শুরু হয়েছিলো সমন্বিত অ্যাথলেটিক ট্রেনিংয়ের যুগ। সেই সাথে টানা ১২ বছর ধরে সমান শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখায় লোকেরা অ্যাথলেটদের কার্যকাল নিয়েও নতুন করে ভেবেছিলো।
ফিলোস্ত্রাতাস বলছেন-এমন করে শক্তি ও গতিকে দীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষস্থানে রাখা বুঝি আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
আহ! আহ, ফিলোস্ত্রাতাস। আপনি যদি আজ বেচে থাকতেন, তাহলে দেখতে পেতেন দুই সহ¯্রাধিক বছর পর সেই লিওনিডাসের পুনর্জন্ম হয়েছে।