আমি অতিথি তোমারই দ্বারে, ওগো বিদেশিনী!

তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।

রবীন্দ্রনাথের সিন্ধুপারের বিদেশিনী আর তাঁর প্রেমে মজে যাওয়ার গল্পই হবে আজ!

  • গল্পটা মাইক ব্রিয়ারলি

ইংলিশ এই ক্রিকেটারের পরিচয় দেওয়াটা জরুরী। পরিচয় না দিলেও স্রেফ নামের সুবাদেই হয়তো অনেকে তাঁকে চিনে ফেলবেন। কারণ এ গল্পটা মাইক ব্রিয়ারলির। শুধু অধিনায়কত্ব দিয়েই যে একজন ক্রিকেট ময়দানে টিকে থাকতে পারেন – তার বড় প্রমাণ ব্রিয়ারলি। তাঁর মত সংবেদনশীল, সহানুভূতিশীল, স্পষ্টবাদী, ক্রিকেটমনস্ক অধিনায়ক ক্রিকেটের ইতিহাসেই আর আসেনি বললেই চলে।

অভিষেক হিসেব করতে বসলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর আগমন ঘটেছিল বড্ড বেশি বয়সে, ৩৪ বছরে! তবে ৩৪ বছরে সাদা পোশাকে পা রাখলে কি হবে, অধিনায়ক হিসেবে মাইক ছিলেন তুখোড়। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার রডনি হগ তো মনে করতেন, মাইকের কাছে অতিরিক্ত একটা ডিগ্রি আছে – ‘ডিগ্রি ইন পিপল’। তাই তো, ৩৯ টেস্টে মাত্র ২২.৮৮ গড়ে নয় হাফ সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানটিকেও ইংল্যান্ড ক্রিকেট শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন তাঁর অধিনায়কত্বেন জন্য।

দেরিতে অভিষেক ঘটলেও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা ৩৯ টেস্টের ৩১ টিতেই মাইক ছিলেন দলের অধিনায়ক। ছোট্ট এই অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারে তিনি ১৭ ম্যাচ জয়ের বিপরীতে হেরেছেন মাত্র চারটি ম্যাচ। মাইক কিন্তু চাইলেই নিজেকে ইংলিশ ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হিসেবে দাবি করতে পারেন!

আরো পড়ুন

কিন্তু, আজকের গল্পটা মাইক ব্রিয়ারলির ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে নয়। এমনকি ক্রিকেট ছাড়ার পর তিনি যে সাইকোঅ্যানালিস্ট হয়েছেন সেটা নিয়েও নয়!

মাইক ব্রিয়ারলি তাহলে আর করেছেন টা কি?

  • ভারত সফরের স্মৃতি

সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর-

শঙ্খমালা নাম তার : এ বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে

তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো-বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,

তাই-সে-জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।

জীবনানন্দ দাস বলেছিলেন, খুঁজে পেয়েছেন মাইক ব্রিয়ারলি!

ঘটনাটা ১৯৭৬ এর, মাইক ব্রিয়ারলি তখন ইংল্যান্ড দলে সদ্য অভিষিক্ত হয়েছেন। সেসময়েই তিনি আসেন ভারত সফরে। ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে ভারত সফরে আসায় নানা জনের সাথে ব্রিয়ারলির সাক্ষাৎ হয়। ঠিক এরকম একটি সাক্ষাতের পরিবার ছিল গুজরাটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্ট অম্বলাল সারাভাই এর পরিবার। অম্বলাল সারাভাই এর সপরিবার সাক্ষাতের আগে ব্রিয়ারলি কি ঘুণাক্ষরেও জানতেন, নিজের জীবনের নিখাদ সত্যির সাক্ষাৎ আর কিছু পরেই পেতে যাচ্ছেন তিনি!

  • মানা সারাভাই

সারাভাই পরিবারের বড় মেয়ের নাম ছিল মানা সারাভাই। মাইক ব্রিয়ারলি সে সাক্ষাতে মানা সারাভাইকেও দেখেন। এতদিন পর কে কাকে বোল্ড আউট করে সেটা অবশ্যি সত্যি করে বলতে পারিনা, কিন্তু শুভদৃষ্টির পর দেখা যায় মানা সারাভাই আর মাইক ব্রিয়ারলি দুজনে বৈদেশ-বাসীর প্রেমে মজে গেছেন।

মাইক ব্রিয়ারলির এই প্রণয় অবশ্য খুব বেশি ঝড়-ঝাপ্টা দেখেনি। অম্বলাল সারাভাই তাঁর বড় মেয়ের কন্যা সম্প্রদান করে দেন মাইকের হাতেই, আর অচিরেই লন্ডনের মাইক ব্রিয়ারলি হয়ে যান আহমেদাবাদের জামাই!

  • ভালবাসা! এরপর?

সৌন্দর্যের দেশ ভারতের এক বিদেশীনিকে তো বিয়ে করা হল, মাইক কিন্তু এরপরই থেমে যাননি। তিনি এরপর গুজরাটি শিখতে আরম্ভ করলেন। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার- প্রেমের কাব্যে দেশের ব্যাবধান থাকলে থাকুক, ভাষার ব্যাবধান অন্তত ঘুচে যাক!

১৯৮৫-১৯৮৮ অব্দি মাইক ব্রিয়ারলি ভারতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে লাগলেন। গুজরাটি শেখার জন্যে ধরনা দিলেন বিখ্যাত গুজরাটি কবি স্বরূপ ধ্রুবের দ্বারে। স্বরূপও বেশ ভালভাবেই মাইককে গুজরাটি শেখাতে লাগলেন। ২০১১ এ স্বরূপ একবার তাঁর এক সাক্ষাৎকারে তাঁর ছাত্র মাইককে নিয়ে বলেছিলেন, মাইক নাকি গুজরাটি শেখার জন্যে উদগ্রীব ছিল। এমনকি বেশ নিয়মমাফিকও ছিলেন তিনি। তাকে দেওয়া সব কয়টি হোমওয়ার্ক তিনি বেশ ভালভাবেই করতেন।

খেলাধুলার চাপ, ক্রিকেটের পর হয়েছেন সাইকোঅ্যানালিস্ট, এত কিছুর মধ্যেও গুজরাটি শিখে গেছেন মাইক। মানা সারাভাইকে তিনি এতটাই ভালবাসতেন!

  • এখন?

মানা সারাভাই এখন মানা ব্রিয়ারলি হয়েছেন। অন্তত উইকিপিডিয়া সেরকমই বলছে। মানা আর মাইকের ঘরজুড়ে দুটি সন্তানও এসেছে। নিজেরা সুখে-শান্তিতেও আছেন বেশ। তবে ভারতকে কিন্তু মাইক ভুলে যাননি। এখনও প্রতি ডিসেম্বরে তিনি ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে গুজরাটে আসেন, মানার পরিবার আর আত্মীয়দের সাথে সময় কাটান।

কেন কাটান? মাইক ব্রিয়ারলি ২০১১ তে এসেই সেটা বলেছিলেন, ‘যদি ও ১১ মাস সব ছেড়ে আমার সাথে লন্ডনে কাটাতে পারে, আমি কেন ওর জন্যে ১ মাস আহমেদাবাদে কাটাতে পারব না!’

সত্যিই তো!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link