মিস্টার প্রক্টরশায়ার

পেস বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করলেও ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল একদম ভিন্ন চিত্রের! নিজের স্কুল দলের হয়ে খেলেছিলেন একজন উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে। ১২ বছর বয়সেই তাঁর স্কুলের হয়ে পাঁচ সেঞ্চুরি করেন তিনি! কিন্তু তার কোচ তাকে স্পিনার হওয়ার উপদেশ দেন।

১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ২১ বছর ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা দল। বোর্ডে দেশটির সরকারের হস্তক্ষেপে আইসিসি থেকে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ২১ বছরে দেশটির অনেক তারকা ক্রিকেটারই নিজেদের প্রমাণের সুযোগ পাননি।

কেউ কেউ অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে খেলেছেন। কেউ বা আবার পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে। তবে নির্বাসনে থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক সম্ভাবনাময়ী তারকা ক্রিকেটারই ক্যারিয়ারের সেরা অবস্থানে যেতে পারেনি। এই আক্ষেপটা রয়ে গিয়েছে সেই সময়ের প্রোটিয়া ক্রিকেটারদের মাঝেও।

এই আক্ষেপের তালিকায় রয়েছেন সে সময়ের দুর্দান্ত এক অলরাউন্ডার মাইক প্রক্টর। ১৯৬৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাদা পোশাকে অভিষেক। অভিষেক ম্যাচেই যিনি শিকার করেন সাত উইকেট। ওই বছর ৩ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। অজিদের বিপক্ষে তিন ম্যাচে শিকার করেন ১৫ উইকেট।

এরপর আর তিন বছর দলে সুযোগ পাননি! ১৯৭০ সালে নির্বাসনের আগে ৪ টেস্টে খেলেন তিনি। ওই ৪ টেস্টেও নেন ২৬ উইকেট! বোলিং অলরাউন্ডার হলে ব্যাটিংয়ে ঠিক মত সুবিধে করতে পারেননি তিনি। তবে লোয়ার অর্ডারে তার পাওয়ার হিটিং খেলার সক্ষমতা নিয়ে কোনো দ্বিধাই ছিল না। এরপর ২১ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞায় দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট!

চট জলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন উড়াল দিবেন ইংল্যান্ডে। গ্লস্টারশায়ারের সাথে ১৯৬৫ সাল থেকেই চুক্তিবদ্ধ ছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারের বাকি গল্পটাও তাই সাজান সেখানেই!

পেস বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করলেও ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল একদম ভিন্ন চিত্রের! নিজের স্কুল দলের হয়ে খেলেছিলেন একজন উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে। ১২ বছর বয়সেই তাঁর স্কুলের হয়ে পাঁচ সেঞ্চুরি করেন তিনি! কিন্তু তার কোচ তাকে স্পিনার হওয়ার উপদেশ দেন।

তবে সেটিকে ছাপিয়ে মাইক প্রক্টর তিনি বেছে নেন পেস বোলিং। আর পরবর্তীতে কিনা পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই অর্জন করেন সাফল্য। প্রক্টর নিজেও এসেছিলেন ক্রিকেট পরিবার থেকেই। তাঁর বাবা এবং ভাই দু’জনেই খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। ক্রিকেটার পরিবার থেকে আসায় ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়তে মোটেও বিপাকে পড়েননি প্রক্টর।

ছোটবেলা থেকেই ন্যাচারাল অ্যাথলেট ছিলেন তিনি। স্কুলে থাকাকালীন হকি, স্কোয়াশ, লন টেনিস ছাড়াও অ্যাথলেটিকে নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি। সে কারণেই অনেকটা বিচিত্র বোলিং স্টাইল ছিল প্রক্টরের। লম্বা বাবরি চুলে দৌড়ে এসে ‘Wrong foot’ এ বল করতেন তিনি।

গ্লুচেস্টারশায়ারের খেলার সময় তিনি প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছেন ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, অ্যান্ডি রবার্টস, ওয়াসিম আকরামদের মতো তারকাদের! কাউন্টিতেই নিজের নামের সাথে যোগ করেন বেশ কিছু রেকর্ড। ১৯৭৭ সালে উষ্টারশায়ারের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে লাঞ্চ বিরতির আগেই সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি। ওই ম্যাচে বল হাতে হ্যাট্রিক সহ ৭৩ রানে একাই ১৩ উইকেট শিকার করেন প্রক্টর!

একই বছর বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপের সেমিফাইনালে হ্যাম্পাশায়ারের বিপক্ষে গ্লস্টারশায়ার প্রথমে ব্যাট করে ৬০ ওভারে মাত্র ১৮০ রান করে! জবাবে ব্যাট করতে নেমে প্রক্টরের ম্যাজিকেল স্পেলে মুখ থুবড়ে পড়ে হ্যাম্পাশায়ারের ব্যাটিং লাইন আপ! পাঁচ বলের মাঝেই হ্যাটট্রিক সহ চার উইকেট শিকার প্রক্টর! ঠিক দু’বছর পরই ১৯৭৯ সালে লিস্টারশায়ারের বিপক্ষে একই কাণ্ড ঘটান তিনি।

লাঞ্চ বিরতির আগেই সেঞ্চুরি পূর্ণ করার পর বল হাতে হ্যাটট্রিক গড়েন এই অলরাউন্ডার। একই বছর ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকানোর কীর্তি গড়েন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গ্যারি সোবার্সের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এই রেকর্ড গড়েন মাইক প্রক্টর। অবশ্য এটি এক ওভারে সম্ভব হয়নি।

১৯৭৯ সালে টন্টনে সমারসেটের বিপক্ষে বাঁ-হাতি স্পিনার ডেনিস ব্রেকওয়ালের ওভারে শেষ দুই বলে দুই ছক্কা হাঁকান প্রক্টর। মাঝে ইয়ান বোথাম এক ওভার মেইডেন দেন অ্যান্ডি স্টোভোল্ডকে। পরের ওভারেই আবারো ব্রেকওয়েলকেই বোলিংয়ে আনেন অধিনায়ক। আর সেই ফায়দা লুটে নিয়ে টানা চার বলে চার ছক্কা হাঁকিয়ে ছয় ছক্কা পূর্ণ করেন প্রক্টর!

অবশ্য আরেকটি কীর্তি আছে প্রক্টরের নামের পাশে। ১৯৭১ সালে সিবি ফ্রাই ও ডন ব্র‍্যাডম্যানের পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা ৬ সেঞ্চুরি করেন মাইক প্রক্টর। নাতাল বি এর বিপক্ষে ১১৯ রানের পর ট্রান্সভাল বি এর বিপক্ষে খেলেন ১২৯ রানের ইনিংস। পরবর্তীতে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের বিপক্ষে করেন ১০৭ রান, ইস্টার্ন ট্রান্সভালের বিপক্ষে খেলেন ১৭৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস! সবশেষে ওয়েস্টার্ন প্রোভিন্সের বিপক্ষে ২৫৪ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে টানা ৬ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি।

১৯৬৫ থেকে ১৯৮১ – প্রায় ১৬ বছর গ্লুচেস্টারশায়ারের হয়ে ২২ গজ দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন মাইক প্রক্টর। করেন অজস্র রান আর শিকার করেছেন অসংখ্য উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪০১ ম্যাচে ৩৬ গড়ে করেছেন প্রায় ২২ হাজার রান!

আছে ৪৮ সেঞ্চুরি আর ১০৯ ফিফটি! সেই সাথে বল হাতে শিকার করেছেন ১৪১৭ উইকেট! ৭০ বার ৫ উইকেট এবং ১৫ বার শিকার করেছেন ১০ উইকেট! লিস্ট এ ক্রিকেটে ২৭১ ম্যাচে ২৮ গড়ে করেছেন সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি রান। আছে ৫ সেঞ্চুরি আর ৩৬ ফিফটি! বল হাতে শিকার করেছেন ৩৪৪ উইকেট।

১৯৮০ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার গ্রিন কার্ড পান প্রক্টর। কিন্তু ততদিনে বয়সটা ৩৪ এর কোঠায়! সে সময় ইংল্যান্ড দলে অলরাউন্ডারের স্লটে ইয়ান বোথাম ছিলেন সেরা অবস্থানে। ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে উপেক্ষিত ট্যাগটা নামের পাশে যোগ করতে চাননি প্রক্টর। ঘরোয়া ক্রিকেটককেই জাপটে ধরে কাটিয়ে দেন ক্যারিয়ারের বাকিটা সময়।

পুরো ক্যারিয়ার টাই যেন বিস্ময়ে ভরা! ঘরোয়া ক্রিকেটে অজস্র রান আর উইকেট ঝুলিতে থাকা সত্ত্বেও এই মানুষটি জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পেরেছেন মোটে সাত ম্যাচ। দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেট নিষিদ্ধ না হলে হয়তো নিজেকে নিয়ে যেতেন সেরাদের কাতারে। ১৬ বছর গ্লুচেস্টারশায়ারের হয়ে খেলার পর অনেক সমর্থকই দলটির নাম দিয়েছিলেন প্রক্টরশায়ার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link