মোহাম্মদ হাসনাইন, কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না

সতেরোতে জুনিয়র বিশ্বকাপ, আঠারোতে পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) আর ঊনিশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট! শুনে কি সহজ মনে হচ্ছে? অথচ পথটা অতটাও সহজ ছিল না। হায়দ্রাবাদের অলিগলির সেই টুর্নামেন্ট থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ পর্যন্ত পৌঁছাতে মোহাম্মদ হাসনাইনকে পাড়ি দিতে হয়েছে কণ্টকাকীর্ণ এক পথ।

পাকিস্থানকে বলা হয় পেসারদের স্বর্গরাজ্য। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতারদের মতো অসাধারণ সব ফাস্ট বোলাররা ভীতি ছড়িয়েছেন ব্যাটসম্যানদের মাঝে। হালের মোহাম্মদ হাসনাইনও কম যান না, ১৫০ কিমির উপর গতি আর বাউন্সারে নাভিশ্বাস তুলে দেন ব্যাটসম্যানদের। শাহীন শাহ আফ্রিদি, হারিস রউফ কিংবা নাসিম শাহদের ছাপিয়ে বাইশ বছরের এই তরুণ তুর্কিই এখন পাকিস্থানের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার।

অথচ এই পর্যায়ে আসতে হাসনাইনকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। হায়দ্রাবাদের হীরাবার নামক জায়গায় হাসনাইনের বাবার ছিল গবাদিপশুর খাবারের দোকান। তিনি নিজেও একসময় ক্রিকেটার ছিলেন, নিজের আর্থিক দুরবস্থা আর সাংসারিক চাপে বেশিদূর যেতে পারেননি। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা ছিল অটুট। একদিন রাতে দোকান থেকে বাড়ি ফেরার সময় স্থানীয় এক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ম্যাচ দেখতে গিয়ে অবাক তিনি।

হ্যালোজেন বাতির আলোয় দেখেন প্রথম ওভার বল করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তাঁর ছোট ছেলে হাসনাইন। তার কল্পনাতেই ছিল না তার চুপচাপ, শান্তশিষ্ট ছোট ছেলেটা পেস বোলিং করতে জানে। সেদিন প্রথম ওভারেই মেডেনসহ তিন উইকেট নিয়েছিলেন হাসনাইন। ওভারের শেষে হাসনাইনের বাবার অবস্থা কি হয়েছিল সেটা অজানাই থাক! তবে ছোট ছেলেকে যে ক্রিকেটারই বানাবেন সেই প্রতিজ্ঞাটা তিনি তখনই করে ফেলেছিলেন।

‘পেস বোলার তৈরি করা যায় না, তারা জন্মায়’ – পাকিস্থানের বহুল প্রচলিত এক বাণী। আপনি চেষ্টা করে বলের লাইন-লেংথ ঠিক করতে পারবেন, নতুন ভ্যারিয়েশন আনতে পারবেন কিন্তু কখনোই গতি বাড়াতে পারবেন না। হাসনাইন জোরে বল করার ঈশ্বরপ্রদত্ত বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। প্রথমবার যখন ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হতে যান, তার বোলিং দেখার পর সবাই অবাক হয়ে যান।

তাঁরা ভেবেছিলেন হাসনাইন কোনো প্রখ্যাত কোচের অধীনে অনুশীলন করেন। অথচ তখনো পর্যন্ত হাসনাইনের ক্রিকেটে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছিল না। তবে ছোটবেলা থেকেই তিনি ভীষণ পরিশ্রমী ছিলেন। প্রতিদিন সকালে স্থানীয় স্টেডিয়ামে ৮ কিমি দৌড়ে দিন শুরু করতেন, এরপর বিশ্রাম নিয়ে নেটে প্রায় বিশ ওভার বল করতেন। পাকিস্থানের তীব্র গরম কিংবা বর্ষার বৃষ্টি কোনো কিছুই হাসনাইনকে তার রুটিন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

হাসনাইনের এই পর্যায়ে আসার পেছনে তার পরিবারের অবদানও কম নয়। তার বাবা প্রতিদিন তার সাথে অনুশীলনে যাতায়াত করতেন। এমনকি তার ভাই-বোনেরা নিজেদের ভাগের দুধপর্যন্ত তাকে খেতে দিতেন যেন তার পুষ্টির কোনো অভাব না হয়। হাসনাইনও পরিবারের এই চেষ্টা বৃথা যেতে দেননি, মাত্র আঠারো বছরেই পেয়ে যান কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটার্সের হয়ে পিএসএলে খেলার সুযোগ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

হাসনাইন প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১৯ সালের পিএসএলে ১৫১ কিমি গতিতে বল করে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয় হাসনাইনের, সে ম্যাচে উইকেট না পেলেও ঠিকই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন।

তাঁকে নিয়ে পাকিস্থানি নির্বাচকরা এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন, পরের মাসেই সরাসরি ডেকে নেন পাকিস্থানের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। বিশ্বকাপে বলার মতো কিছু কর‍তে না পারলেও, কয়েক মাস পরেই সিপিএলে ১৫৫.১ কিমি গতিতে বল করে আলোচনায় আসেন তিনি। এখনো পর্যন্ত সিপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গতির বল সেটি। এ বছরের শুরুতেই করেন ছোটবেলার সেই ওভারের পুনরাবৃত্তি, বিগ ব্যাশে নিজের অভিষেক ওভারেই মেডেন সহ নেন তিন উইকেট।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাসনাইনের বোলিং অ্যাকশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইসিসি। তবে ফিরে আসতে বেশি সময় নেননি তিনি, মাসচারেক পরই পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে বৈধতা পান। সম্প্রতি মার্কাস স্টয়নিস হাসনাইনের অ্যাকশন নিয়ে মাঠেই প্রশ্ন তুললে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে। সবাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই তরুণ পেসারের। দায়িত্বটা এখন হাসনাইনের, নিজের বোলিং দিয়ে ক্রিকেটবিশ্বকে নিজের পরিচয়টা জানান দেবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link