লালা অমরনাথ – তিনি ভারতীয় স্বর্ণ যুগের ক্রিকেটের এক অবিস্মরণীয় নাম এবং পরবর্তী প্রজন্মের আদর্শ। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান। অধিনায়কত্বও ছিল চোখে পড়বার মতো। এমন মহান ক্রিকেটারকে পাতিয়ালার খেলাধুলা প্রিয় মহারাজা ক্রিকেটের উন্নতির জন্য উৎসাহ ও অনুরোধ করেছিলেন।
কথায় বলে ‘দান-ধ্যান নিজের বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিৎ’। তাই করলেন লালা স্যার। নিজের তিন ছেলেকে নিয়ে পড়লেন। বাবার অত্যাচারে ক্রিকেট ছাড়াও যে অন্য কোনো খেলাও রয়েছে তা ভুলে যেতে বসলেন তিন ভাই।
কেমন ছিল সেই শিক্ষা? নিজের বাগানে মিলিটারি ট্রেনিংয়ের মতো ক্রিকেট ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করেছিলেন। বাগানের চারিদিকে টব কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা করে সাজিয়ে দিতেন পুত্রদের জন্য যাতে ওর মাঝে মাঝে শট খেলে ক্রিকেট বলকে সঠিক প্লেসমেন্ট করতে পারে। আর থাকতো শর্ট বল, যাতে পুল এবং হুক করতে পারে। সারাদিন এই নিয়েই পড়ে থাকতেন।
পিতার এই মিলিটারি শাসন কিন্তু বিফলে যায়নি। পরবর্তীতে তিনজনই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যাদের মধ্যে দুজন ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আর তাদের মধ্যে একজন ভারতের প্রথম বিশ্বজয়ের অন্যতম প্রধান নায়ক হয়ে উঠেছিলেন নিজের অসাধারণ প্রতিভায়। তিনি হলেন মহিন্দর অমরনাথ। সেই মহান মানুষটির গল্প বলবো আজ।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক এই মহান অলরাউন্ডারটির। পরের বছর ভারতীয় স্কুল দল – যারা অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল, তার অংশ হলেন। দলে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ব্রিজেশ প্যাটেল, কারসন ঘাউড়ি, সৈয়দ কিরমানী যারা পরবর্তীতে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিকেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। ব্যাটিং টেকনিক ও পেস বোলিং এর বিরুদ্ধে স্বচ্ছন্দতা সবার নজর কাড়তে সমর্থ হলেন।
১৯৬৯ এর শীতের মৌসুমে যখন বিল লরির অস্ট্রেলিয়া ভারতে টেস্ট সিরিজ খেলতে এলো তখন প্রস্তুতি ম্যাচে ঐ দলের বিরুদ্ধে হাফ সেঞ্চুরি ও দুটি উইকেট নিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ভারতীয় দলে অভিষেক নিশ্চিত করলেন। যদিও ওই সিরিজে তেমন কিছুই করতে পারলেন না। ফলশ্রুতিতে ভারতীয় টেস্ট দলের দরজাও বন্ধ হয়ে গেলো প্রায় ৭ বছরের জন্য।
ঘরোয়া ক্রিকেটে এই সময় যদিও একজন মিডিয়াম পেসার, যিনি ভালো ব্যাট করতে পারেন এমন একজন হিসেবে পরিচিত হতে থাকলেন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমদানি হয়েছে একদিনের ক্রিকেট। ক্রিকেট তখন অন্যভাবে নিতে থাকলো বিভিন্ন দেশ। শুরু হলো প্রথম বিশ্বকাপ। আর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেললেন তিনি।
৭০ দশকের শেষ দিক তথা ৮০ দশকের শুরু থেকে আন্তর্জাতিকে নিজের জাত চেনাতে শুরু করলেন। কিন্তু, এই সময়েই কিছু হাড়হিম করে দেওয়া চোট পেলেন। ইমরান খানের বাউন্সারে পাকিস্তানে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, ইংল্যান্ডে গিয়ে মেরুদণ্ডে চোট পেলেন। ইংল্যান্ডেই কাউন্টি খেলবার সময় রিচার্ড হ্যাডলির বাউন্সারে হুক করতে গিয়ে মাথার পেছনে চোট পেয়ে বহু দিন মাঠে ফিরতে পারলেন না। এই চোট আঘাতের পর লড়াইকে কুর্নিশ করলেন ইমরান খান, ম্যালকম মার্শালদের মতো গ্রেটরা।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমটা তাঁর জীবনের সেরা সময়। পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুটি সিরিজের ১১ টি ম্যাচে ১২০০ রানের কাছাকাছি রান করলেন। পাকিস্তান সিরিজে ভারত ৬ টেস্টের সিরিজ ৩-০ তে হারলেও তিনি প্রায় ৬০০ এর কাছাকাছি রান করলেন। অন্যদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৫ টেস্টের সিরিজে ২-০ তে ভারত হারলেও আবার তিনি ৬০০ এর কাছাকাছি রান করলেন।
এমন রানবন্যা দেখে ভিভ রিচার্ডস বললেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের চতুর্ভূজের বিরুদ্ধে এমন লড়াই করতে খুব কম ক্রিকেটারকেই দেখেছি।’ মাইকেল হোল্ডিং বললেন, ‘চোট-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে ওর লড়াই অসাধারণ।’
এরপর ইংল্যান্ডে শুরু হলো তৃতীয় ওয়ানডে বিশ্বকাপ। আগের দুবারে অসম্ভব খারাপ পারফরম্যান্স দেওয়া ভারতকে গুরুত্ব দেয়নি কোনো দলই, এমনকি প্রথম বার বিশ্বকাপ খেলতে আসা জিম্বাবুয়েও। এটাই শাপে বর হয়ে দাঁড়ালো কপিল বাহিনীর কাছে। নিজেদেরকে প্রমাণ করবার অদম্য ইচ্ছে লড়াই করবার রসদ জুগিয়ে যেতে থাকলো।
প্রথম দু’ম্যাচেই আগের দুবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নবাগত জিম্বাবুয়েকে হারালো ভারত।।বল না করলেও ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রান করলেন। এরপর কয়েকটি ম্যাচে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ভারত হেরে গেলো। যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেললেন অসাধারণ ৮০ রানের একটি ইনিংস।
অসাধারণ লড়াই করে যখন ভারত সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হলো তখন ইংল্যান্ডের পত্র পত্রিকায় ইংল্যান্ডকে প্রায় চাম্পিয়ন ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। আর ভারতের মতো একটি যে কোনো সুযোগই পাবেনা সেমিতে তাও ফলাও করে লেখা হলো। কিন্তু, পুরো ভারতীয় দলের সাথে এই অলরাউন্ডারও অন্য কথা ভেবেছিলেন।
প্রথমে ২১৩ রানে ইংল্যান্ডকে আটকে রাখতে ১২ ওভারে মাত্র ২৭ রান দিয়ে ডেভিড গাওয়ার ও মাইক গ্যাটিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট এবং পরে ব্যাট করতে নেমে দায়িত্বশীল ৪৬ রানের ইনিংস ভারতের স্বপ্ন ছোঁয়ার শেষ ধাপে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ম্যাচের সেরা তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভাবার ছিল না, ভাবাও হয়নি।
কিন্তু, স্বপ্ন দেখা আর তাঁর বাস্তবায়নের মধ্যে জমিন-আসমান পার্থক্য থাকে। ফাইনালে সেই ক্লাইভ লয়েডের প্রায় অপরাজেয়,ভয়ঙ্কর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাঁদের তৃতীয়বার বিশ্বজয় আটকাতে হলে অস্বাভাবিক কিছু করতে হবে। যদিও ভরসা বলতে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ওই দলের বিরুদ্ধেই জয় ছিল।
টসে জিতে কিংবদন্তি লয়েড যখন ভারতকে প্রথমে ব্যাট করবার আমন্ত্রণ জানালো তখন বিশ্ব অস্বাভাবিকতা কিছুই দেখলো না বা আভাসও পেলো না।কয়েকটি ছোট ছোট ইনিংসে ভিত্তি করে ৫৫ ওভারের আগেই যখন ১৮৩ রানে আটকে গেলো ভারত, তখন বহু সমর্থকই আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
কিন্তু, কপিল বাহিনী যোদ্ধারা অন্যভাবে ভেবেছিল। মদন লাল, বলবিন্দর সান্ধুরা শুরু করেছিলেন আর শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের উপর বুলডোজার চালালেন ওই অলরাউন্ডার। ভিভ রিচার্ডের অসাধারণ কিছু শট ছাড়া এমন মহান ব্যাটিং লাইন আপের কেউ দাড়াতেই পারলেন না। মাত্র ১৪০ রানে গুটিয়ে দিয়ে ভারত বিশ্বজয় করলো, যা পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটের রূপরেখায় পাল্টে দিয়েছে।
আর সেই মহান অলরাউন্ডার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ম্যাচের সেরা হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন (পরে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন অরবিন্দ ডি সিলভা, ১৯৯৬ বিশ্বকাপে)। লর্ডসের ব্যালকনিতে বন্ধু-অধিনায়ক কপিলের সাথে হাসিমুখে বিশ্বকাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার ছবি আজীবন ভারতীয় সমর্থকদের মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে।
১৯ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন সাকুল্যে ৬৯ টি, খেলতে সুযোগ পাননি ৬৪ টি তে। ১১ টি সেঞ্চুরি করলেও তাকে ১৩৮ রানের বেশি নিয়ে যেতে পারেননি। অন্যদিকে ১৪ বছরের ওয়ানডে ক্রিকেটিং ক্যারিয়ারও তেমন আহামরি নয়। কিন্তু এমন ক্রিকেটারকে শুধু তথ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না।
ভারতীয় ক্রিকেটে অবদান, ভারতীয় ক্রিকেটকে পথ দেখানো সর্বোপরি চোট-আঘাত-যন্ত্রণা সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে হুক করে সর্বদা মাঠের বাইরে ফেলেছেন। নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যেখানে খুব কম মানুষই পৌঁছাতে পারবেন।