মহিন্দর ‘মহান’ অমরনাথ

লর্ডসের ব্যালকনিতে ট্রফি হাতে কপিল দেবের সেই ছবি পাল্টে দিয়েছে গোটা ভারতের ক্রিকেট মানচিত্র। তখনকার ভারতের সেরা তারকা কপিল দেব কিংবা সুনীল গাভাস্কার হলেও সেমিফাইনাল আর ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ছিলেন তিনিই। ফাইনালে প্রথমে ব্যাটিং এ নেমে ২৭ রান করে দলকে এনে দিয়েছেন লড়াকু পুঁজি।

লর্ডসের ব্যালকনিতে ট্রফি হাতে কপিল দেবের সেই ছবি পাল্টে দিয়েছে গোটা ভারতের ক্রিকেট মানচিত্র। তখনকার ভারতের সেরা তারকা কপিল দেব কিংবা সুনীল গাভাস্কার হলেও সেমিফাইনাল আর ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ছিলেন তিনিই। ফাইনালে প্রথমে ব্যাটিং এ নেমে ২৭ রান করে দলকে এনে দিয়েছেন লড়াকু পুঁজি।

পরে মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ক্যারিবিয় অহমিকা। জেফ ডুজন , ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংকে আউট করে ভারতকে এনে দেন পরম আরাধ্য শিরোপার স্বাদ। অথচ প্রথম দর্শনে তাকে ক্রিকেটার বলে মনে হয় না, লম্বা-সুদর্শন চেহারার তাকে বোম্বের নায়ক ভেবে ভুল করেন অনেকেই। তিনি মহিন্দর অমরনাথ, ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। 

ক্রিকেটপ্রেমী এক পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা লালা অমরনাথ ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক। ভারতের হয়ে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ডও তাঁর দখলে। বড় ভাই সুরিন্দরও জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেন। ছোট ভাই রাজিন্দর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছেন।

সব মিলিয়ে পুরাদস্তুর ক্রিকেটীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠা মহিন্দরের। ১৯৬৯ সালে চেন্নাইয়ে ভারতের হয়ে অভিষেক তাঁর। দারুণ ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও কার্যকরী ছিলেন তিনি। গতি বেশি না হলেও মাপা লাইন-লেংথ আর সুইং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে ফেলতেন। তবে অমরনাথ বিখ্যাত ছিলেন ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ের জন্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একবার মাথায় বল লেগে বাইরে চলে যান।

সবাই ভেবেছিলেন প্রাণটাই বুঝি বেঘোরে গেল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে মাথায় সেলাই নিয়েই আবারও ফিরে আসেন মাঠে। মাইকেল হোল্ডিংয়ের পরের বাউন্সারেই  হুক, বলের ঠিকানা সীমানা পেরিয়ে গ্যালারি। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এতটাই দুঃসাহসী ছিলেন তিনি। ইমরান খান ,ম্যালকম মার্শালরা তাকে আখ্যায়িত করেছেন সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে। 

পেস বোলিং এর বিপক্ষে ছিলেন বরাবরই সাবলীল। এগারো টেস্ট সেঞ্চুরির ৯টিই তাই উপমহাদেশের বাইরে। পেসারদের চোখে চোখ রেখে আগ্রাসী মনোভাবে ব্যাট করতেন। তবে সবকিছু সত্ত্বেও ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা দীর্ঘায়িত হয়নি তাঁর, সব সময় দলে-আসা যাওয়ার মাঝেই ছিলেন। তাকে ডাকা হতো ‘দ্য কামব্যাক ম্যান’ নামে। অবশ্য বাদ পড়ার  পেছনে কারন ছিল তাঁর চাঁচাছোলা কথাবার্তার।

নির্বাচকদের একবার ডেকেছিলেন ‘আ বাঞ্চ অব জোকার্স’ বা ‘জোকারের দল’ বলে। ক্রিকেট মাঠে অদ্ভুত কিছু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বল হাত দিয়ে ধরে আউট হন তিনি। এছাড়া অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ডিং কিংবা হিট উইকেটও হন তিনি। তিনিই বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি উপরোক্ত তিন ভাবেই আউট হয়েছেন। তাছাড়া কুসংস্কারে বিশ্বাসী অমরনাথ পকেটে সব সময় লাল রুমাল রাখতেন। তাঁর ধারণা ছিল লাল রুমাল ছাড়া তিনি মৃতপ্রায়।

প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারে ১১ সেঞ্চুরি আর ২৪ হাফ-সেঞ্চুরিতে তাঁর সংগ্রহ ৪,৩৭৮ রা। একদিনের ক্রিকেটে পরিসংখ্যানটা অবশ্য কিছুটা বিবর্ণ, ১,৯২৪ রানের পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৪৬ উইকেট। অবশ্য পরিসংখ্যান দিয়ে অমরনাথকে মাপা যাবে না, ভারতকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে যে গোটা ক্রিকেট ইতিহাসের গতিপথই যে খানিকটা পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৯ সালে অবসর নেন সব ধরনের ক্রিকেট থেকে। 

মাঠ থেকে অবসর নিলেও ক্রিকেটটা ছিল তাঁর রক্তে মিশে। খেলা ছাড়ার পর তাই জড়িয়ে পড়েন ক্রিকেট কোচিং এর সাথে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম হাইপ্রোফাইল কোচ। কেবল হাঁটতে শুরু করা বাংলাদেশকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আধুনিক ক্রিকেটের সাথে।

দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়নের পেছনে বড় অবদান ছিল তাঁর। যদিও মোটা দাগে অমরনাথের বাংলাদেশে কোচিং ক্যারিয়ার ব্যর্থ বলা চলে। তাঁর অধীনেই ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সুযোগ করে নিতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। তবুও তাঁর নেয়া সাহসী সিদ্ধান্তগুলো পরবর্তীতে এগিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে।

এছাড়া কয়েকটি বলিউড ছবিতেও কাজ করেছেন অমরনাথ। পরিসংখ্যান কিংবা রান সংখ্যা দিয়ে অমরনাথের মতো ক্রিকেটারদের কখনোই মাপা যায় না, তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকেন তাদের লড়াকু সত্ত্বার জন্য, হাল না ছাড়া মানসিকতার জন্য।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link