ব্যবসা বিদ্যার মোনাকো অধ্যায়

ইউরোপের ফুটবল বাজার সর্বদাই যেন থাকে গরম। এই যেমন এবারের দলবদলের সবচেয়ে বড় খবর নিঃসন্দেহে ছিলেন ফ্রেঞ্চ তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে। তাঁর রিয়াল মাদ্রিদ যাত্রা নিয়ে তো কম জল ঘোলা হয়নি। এরপর অবশ্য তিনি তাঁর বর্তমান ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইতেই থেকে যাচ্ছেন। তবে এই যে এমবাপ্পেকে নিয়ে এমন একটা রহস্য ঘেরা সময় পার করার পেছনের কারণ এই খেলোয়াড়ের সার্বিক উন্নতি

নিজেকে যেন একেবারে ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি। সম্ভাবনাময় তরুণ থেকে এখন তিনি ফুটবলের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একজন। তবে তাঁর এমন দিন বদলের পেছনে অবশ্য আরেক ফ্রেঞ্চ ক্লাব মোনাকোর হাত রয়েছে। ইউরোপের ফুটবলে খেলোয়াড়দের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে ক্লাবগুলো। সে সব ক্লাবগুলোর মধ্যে এএস মোনাকো অন্যতম।

অবশ্য তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের পরিচর্যার পেছনে থাকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য। খেলোয়াড়দের মান বাড়লে ইউরোপের বাজারে তাঁদের চাহিদা বাড়ে। আর চাহিদার সাথে সমানতালে বাড়ে অর্থমূল্য। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এখন অবধি প্রায় এক বিলিয়ন ইউরোর বেশি ব্যবসা করেছে ক্লাবটি খেলোয়াড় বিক্রয় করে। মোনাকোর চড়া দামে বিক্রয় করা খেলোয়ড়দের নিয়েই থাকছে আজকের আয়োজন।

  • টিমোয়ে বাকাইয়োকো (চেলসি)

১৯ বছর বয়সে মোনাকোতে এসেছিলেন বর্তমানে এসি মিলানের হয়ে ধারে খেলা টিমোয়ে বাকাইয়োকো। মাত্র তিনটি মৌসুম তিনি পার করেছিলেন ফ্রেঞ্চ ক্লাবটির হয়ে।

২০১৬-১৭ মৌসুমের মোনাকোর লিগ জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। তারপরই মূলত ইউরোপের বড় দলগুলোর চোখ পড়ে তাঁর দিকে। সবার সামনে দিয়ে তাঁকে ৪০ মিলিয়ন ইউরোতে কিনে নেয় ইংলিশ ক্লাব চেলসি।

  • ইউরি টাইলেম্যানস (লেস্টার সিটি)

বেলজিয়ামের এক ক্লাব থেকে ২০১৭ সালে ২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইউরি টাইলেম্যানসকে দলে ভেড়ায় মোনাকো। দেড় মৌসুম তিনি ছিলেন মোনাকো ডেরায়।

ফরাসি ক্লাবটির সাথে শুরুটায় মানিয়ে নিতে খানিক বেগ পেলেও ক্রমশ তিনি ক্লাবের মধ্যমাঠের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। তবে ২০১৯ এর জানুয়ারি ট্রান্সফারে ইংলিশ ক্লাব লেস্টার সিটি তাঁর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে। শেষমেশ ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান ইউরি টাইলেম্যান।

  • ফ্যাবিনহো (লিভারপুল)

রিয়াল মাদ্রিদ যুব দলের হয়ে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করলেও ফ্যাবিনহো নিজেকে সম্ভাবনাময় একজন খেলোয়াড় হিসেবে প্রকাশ করতে পেরেছেন মোনাকোর জার্সিতে। প্রথম দুই মৌসুম ধারে খেললেও এরপর তিনি পাকাপোক্তভাবে থিতু হন মোনাকোতে।

একজন রাইট ব্যাক হিসেবে শুরু করলেও ক্রমশ তিনি আলো কাড়েন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। ২০১৮ সালে ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে লিভারপুলে যোগ দেন ফ্যাবিনহো।

  • বার্নার্ডো সিলভা (ম্যানচেস্টার সিটি)

এই সময়ে অন্যতম সেরা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের একজন বার্নার্ডো সিলভা। পর্তুগালের বেনফিকা থেকে তিনি চলে এসেছিলেন মোনাকোতে। মোনাকোর হয়ে ইউরোপীয় ফুটবলে দ্যুতি ছড়াতে থাকেন সিলভা।

এরপর ২০১৭ মৌসুম শেষে তাঁর প্রতি আগ্রহ দেখায় বর্তমান সময়ের ধনী ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি। অগ্যতা ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে নিজের বিশাল বড় এক প্রতিভার মায়া ত্যাগ করে মোনাকো।

  • বেনজামিন মেন্ডি (ম্যানচেস্টার সিটি)

২০১৭ দলবদলে বার্নার্ডো সিলভা ছাড়াও আরও এক মোনাকোর খেলোয়াড়কে নিজেদের শিবিরে নিয়ে গিয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি।

মোনাকোর ফুলব্যাক বেনজামিন মেন্ডিকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ খরচে নিজেদের করে নিয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি। ৫৭.৭ মিলিয়ন ইউরোতে সিলভার সাথে মেন্ডিও চলে যান ইংল্যান্ডে। সে সময়ে সবচেয়ে দামি ডিফেন্ডারের তকমাও জুটে গিয়েছিল মেন্ডির গায়ে।

  • অ্যান্টোনি মার্শাল (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)

সম্ভাবনার এক বিশাল ঝুলি নিয়ে ১৭ বছর বয়সে অ্যান্টোনি মার্শাল এসেছিলেন মোনাকোতে। দুই মৌসুম বেশ ভাল কাটিয়েছেন তরুণ মার্শাল।

তাঁর উপর নজর পড়ে ইংলিশ পরাশক্তি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। তাঁর প্রতিভা সন্তুষ্ট করে রেড ডেভিলদের। ৬০ মিলিয়ন ইউরোতে মার্শাল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডকে বানিয়ে ফেলেন নিজের নতুন ঘর। ২০১৫ সালে তিনি ফ্রেঞ্চ ক্লাবটির লভ্যাংশ লাভের কারণ হয়েছিলেন।

  • টমাস লিমার (অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ)

বিশ বছর বয়সে মোনাকোতে এসেছিলেন টমাস লিমার। পরবর্তী তিন মৌসুমে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। আকর্ষণের অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছেন। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে তিনি বেশ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন।

এরপর স্পেনের ক্লাব অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ থেকে ডাক আসে তাঁর। লিমারকে দলে ভেড়াতে ৭২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে ক্লাবটি। ২০১৮ সালে লিমার অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের জার্সি জড়িয়ে সবুজ ঘাসে নিজের কারুকাজ দেখাতে শুরু করেন।

  • হামেস রদ্রিগেজ (রিয়াল মাদ্রিদ)

২০১৪ বিশ্বকাপের বিস্ময় বালক ছিলেন কলম্বিয়ান হামেস রদ্রিগেজ। জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ খেলার আগে তিনি ছিলেন মোনাকোর খেলোয়াড়। বিশ্বকাপের পর পরই বেশ একটা চাহিদা বেড়ে যায় রদ্রিগেজের ইউরোপের ফুটবল মার্কেটে।

যার ফলশ্রুতিতে ৭৫ মিলিয়ন ইউরোতে তাঁকে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে বিক্রি করে দেয় মোনাকো। তরুণ প্রতিভাবান এই খেলোয়াড় মাদ্রিদের হয়ে খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। সব আলো যেন নিস্তেজ হয়ে যায় তাঁর।

  • অরেলিয়েন শুয়েমেনি (রিয়াল মাদ্রিদ)

নিজেদের ভবিষ্যতের মিডফিল্ডটা শক্তপোক্ত করবার প্রচেষ্টায় রয়েছে স্প্যানিশ পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদ। সে ধারাবাহিকতায় অরেলিয়েন শুয়েমেনিকে ১০০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে নিয়ে এসেছে লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। ২০২০ সালে তরুণ উদীয়মান খেলোয়াড় হিসেবে মোনাকোতে এসেছিলেন শুয়েমেনি।

এরপর তিনি ক্রমশ নিজের প্রতিভার প্রদর্শন করতে থাকেন মোনাকোর হয়ে। রিয়াল মাদ্রিদের পছন্দের খেলোয়াড়দের তালিকায় নিজের নামটি তুলে ফেলেন তিনি। সে জন্যেই শুয়েমেনিকে দলে ভেড়াতে অর্থের কার্পণ্য করেনি রিয়াল মাদ্রিদ।

  • কিলিয়ান এমবাপ্পে (প্যারিস সেইন্ট জার্মেই)

মেসি-রোনালদো পরবর্তী সময়ে যে সকল খেলোয়াড়দের পায়ে উজ্জীবিত থাকবে ফুটবল, তাঁদেরই একজন কিলিয়ান এমবাপ্পে। নিজের সার্বিক শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি রীতিমত বনে গেছেন ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের হটকেক। ২০১৫ সালে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু ফ্রেঞ্চ ক্লাব এএস মোনাকোর সাথে।

মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকেই তিনি নিজেকে অনন্য এক সত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে তাঁকে দলে নিতে ২০১৮ সালে আরেক ফ্রেঞ্চ ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই মোট ১৮০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে। সেটাই এখন পর্যন্ত মোনাকোর সর্বোচ্চ দরে খেলোয়াড় বিক্রয়ের রেকর্ড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link