বোনো, স্পেনের ঘরের শত্রু বিভীষণ

বোনো নামটা শুনলেই মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে আইরিশ এক গায়কের কথা, খোলা ময়দানে সুরের জাদুতে মোহিত করছেন হাজারো দর্শকের। কিন্তু গতকাল রাতে তাঁকে ছাপিয়ে গেছেন আরেক বোনো, তিনি মরক্কোন গোলকিপার ইয়াসিন বোনো। টাইব্রেকারে স্প্যানিশদের বিপক্ষে টানা তিন সেভ করে প্রথমবারের মতো মরক্কোকে তুলেছেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে।

নির্ধারিত সময়ের নব্বই মিনিট তো বটেই অতিরিক্ত সময়ের ৩০ মিনিটেও তাঁকে পরাস্ত করতে পারেননি স্প্যানিশ ফুটবলাররা। পরে টাইব্রেকারে তিনটি শট ঠেকিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন ২০১০ বিশ্বকাপের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। এবারের বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে প্রথম অঘটন এটি। ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানার পর দ্বিতীয় দল হিসেবে বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠল কোনো আফ্রিকান দল। 

আর মরক্কোর শেষ আটে উঠার নায়ক ছিলেন বোনো। স্প্যানিশ লিগে খেলার ফলে স্পেনের ফুটবলারদের ভালোই জানা ছিল তাঁর। টাইব্রেকারে শট নেবার সময় প্রতিনিয়ত কথা বলে স্প্যানিশ ফুটবলারদের মনোযোগ নষ্ট করেছেন। পরে পিএসজি তারকা আশরাফ হাকিমির পানেককা শট উনাই সিমনকে পরাস্ত করে জালে জড়ালে শেষ আট নিশ্চিত হয় মরক্কোর। 

বিশ্বকাপের আগে খুব কম মানুষই জানতেন বোনোর নাম। তবে কালকের ম্যাচের পর নিশ্চিতভাবেই বিশ্ববাসী জেনে গেছে তাঁর নাম। বোনো খেলেন লা লিগার ক্লাব সেভিয়াতে। কানাডার মন্ট্রিয়লে জন্ম হলেও খুব ছোটবেলাতেই চলে যান মরক্কোতে। সেখানেই বেড়ে উঠা এবং ফুটবলের হাতেখড়ি। সেখানকার ক্লাব কাসাব্ল্যাংকার হয়ে ১১ ম্যাচও খেলেন শীর্ষ পর্যায়ে। এরপরই তাঁর প্রতিভা বুঝতে পেরে দলে টানে স্প্যানিশ জায়ান্ট অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ। 

কিন্তু অ্যাতলেটিকোতে চলছে ইয়ান অবলাকের রাজত্ব। ফলে দিনের পর দিন বেঞ্চে বসতে হয়েছে, খেলতে হয়েছে বি দলের হয়ে। অবশেষে স্প্যানিশ দ্বিতীয় বিভাগের দল জারাগোজায় লোনে যান তিনি। সেখানেই জানান দেন নিজের সামর্থ্যের। এরপর তাঁকে দলে ভেড়ায় আরেক নিচের দিকের ক্লাব জিরোনা। জিরোনাকে মাত্র দুই মৌসুমের মাঝে তুলে আনেন স্প্যানিশ ফুটবলের শীর্ষ লিগে।

২০১৯ মৌসুমের শুরুতে তাঁকে দলে ভেড়ায় সেভিয়া। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বোনোকে, মাত্র তিন মৌসুমের মাঝে আদায় করে নেন সেভিয়ার গোলরক্ষকের স্থানটা। গত মৌসুমেও ১৫ ম্যাচে কোনো বল ঢুকতে দেননি সেভিয়ার জালে। মরক্কো জাতীয় দলে অবশ্য বোনোর জায়গাটা প্রশ্নাতীত। সেই ২০১৩ সাল থেকেই জাতীয় দলের গোলবার সামলানোর দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। 

বড় ম্যাচে বোনো বরাবরই উজ্জ্বল। ২০২০ ইউরোপা লিগের সেমিফাইনালেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ছয়টি সেভ করে দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। ফাইনালেও এসি মিলানের বিপক্ষে ছিলেন আপন মহিমায় উজ্জ্বল।

সেবার ইউরোপা লিগের শিরোপা ঘরে তুলেছিল সেভিয়া। এরপরই মূলত তাঁর সাথে চার বছরের নতুন চুক্তি করে স্প্যানিশ ক্লাবটি। গত মৌসুমেও ক্লাবের আস্থার প্রতিদান দিয়ে বোনো, দারুণ পারফর্ম করে জিতেছেন সেরা গোলকিপারের পুরষ্কার ‘রিকার্ডো জামোরা ট্রফি’। সেই সময়ে স্বয়ং থিবো কোর্তোয়া প্রশংসা করেছিলেন বোনোর।

তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এবারের বিশ্বকাপে মরক্কোর হয়ে প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নামেননি বোনো। গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষে জাতীয় সংগীত গাইলেও পরবর্তীতে গোলবারের নিচে দাঁড়ান দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক মুনির এল কাজুই। ম্যাচশেষে জানা যায় মাথা ব্যথার অসহ্য যন্ত্রণায় মাঠে নামেননি বোনো। সবাই ভেবেছিলেন খারাপ কিছু ঘটেনি তো! ভাগ্যিস সুস্থ হয়ে উঠেন বোনো। নইলে শেষ আটে উঠার লড়াইতে স্পেনের বিপক্ষে মরক্কোকে এভাবে কে বাঁচাতেন! 

এখনো পর্যন্ত কোনো আফ্রিকান দল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠতে পারেননি। এবার মরক্কোর সামনে সেই কীর্তি গড়ার হাতছানি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের বিপক্ষে কাজটা হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয় মোটেই। বিশ্বকাপে গোলবার অক্ষত রাখা বোনোর উপর ভরসা রাখাই যায়, টাইব্রেকারেও যে এখনো তাঁকে পরাস্ত করতে পারেননি কেউই। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link