ঘুমাও, নয়তো কলিন ক্রফট আসবে!

৭০ দশকের ক্রিকেটে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল। বলা হত, কলিন ক্রফট এতটাই নৃশংস যে, নিজের দাদিমাকে বাউন্সার দিতেও তিনিও দ্বিতীয়বার ভাববেন না। তিনি ছিলেন আনপ্রেডিক্টেবল ও আন-অর্থোডক্স। তিনি ছিলেন খ্যাপাটে, ভীতিকর, খেকী ও ব্যাটসম্যানদের জন্য যন্ত্রনাদায়ক।

এমন একটা সময় তিনি ক্যারিবিয়ান পেস বোলিংয়ে ছিলেন যখন সেখানে মাইকেল হোল্ডিং ছিলেন যিনি একাধারে প্রাণঘাতী ও গতিশীল। ছিলেন জোয়েল গার্নার যিনি খুবই নিঁখুত বোলিং করে উঠতে পারতেন ভয়ঙ্কর। আর ছিলেন ম্যালকম মার্শাল, যার মধ্যে একজন পেস বোলারের যেকোনো গুণের সর্বোচ্চ সীমাটা ছিল। তারপরও এই পেস কোয়াট্রেটের মধ্যে আলাদা ছিলেন কলিন ক্রফট। কারণ, তিনি ছিলেন অপ্রচলিত আর একই সাথে অপ্রত্যাশিত এবং অননুমেয়।

তাঁর এই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ স্টাইলটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। তিনি একেক সময় একেক ভাবে, একেক জায়গা থেকে রান আপটা নিতেন। বিশেষ করে যখন তিনি একদম উইকেট ঘেষে যখন রান আপটা নিতেন তখন আম্পায়ারের জন্য তাঁকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাটসম্যানরা দেখতে পারতেন না, আর যখন আম্পায়ারকে ছাড়িয়ে তাঁকে দেখার সুযোগ হত তখন আর কোনো কিছু বোঝার উপায় থাকতো না।

এই বিষয়টা তাঁকে বিশ্বের বাকি বোলারদের থেকে আলাদা করেছে। এর ফলে আগাম কোনো কিছুই বোঝা যেত না। কখনো ডেলিভারিটা হতো পায়ের পাতা চুরমার করা কোনো ইয়োর্কার, কখনো হত মারাত্মক কোনো বাউন্সার। সাথে তাঁর ছিল দশাসই একটা শরীর। ৬’৫” উচ্চতা, শক্তিশালী পেশিবহুল এক শরীর, চেস্ট-অন অ্যাকশন, আর কাউকে ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা – সব মিলিয়ে তিনি ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম।

বিদ্রোহী সফরে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছিলেন। না হয়, পেস কোয়াট্রেটের বাকিদের মত তাকেও একই পাল্লায় মাপা হত। অন্তত যতদিন ছিলেন বাকিদের চেয়ে কোনো কোনো অংশে এগিয়েই ছিলেন।

১২৫ টি টেস্ট উইকেট পান তিনি মাত্র ২৩.৩০ গড়ে। ১০০-এর ওপর উইকেট আর এর থেকে কম গড়ে উইকেট নেওয়া ক্যারিবিয়ান পেসার ইতিহাসে আছেন আর কেবল তিনজন – ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার ও কার্টলি অ্যামব্রোস। আর ক্রফটের স্ট্রাইক রেট ৪৯.৩, এখানে ৪৬.৭ স্ট্রাইক রেট নিয়ে তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল মার্শাল।

অভিষেক হয় স্বয়ং জোয়েল গার্নারের সাথে। ২৯ রানে নেন আট উইকেট নেন নিজের দ্বিতীয় টেস্টে, পোর্ট অব স্পেনে, পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেটা আজো কোনো ক্যারিবিয়ান পেসারের সেরা বোলিং ফিগার। সেই সিরিজ শেষ করেন ৩৩ উইকেট নিয়ে, গড় ছিল ২০-এর মত।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা আরো ছোট। কিন্তু, তাতেও তিনি ছিলেন অতি মানবীয়। ৩০ উইকেট নিয়েছেন ২০.৬৭ গড়ে। ইকোনমি মাত্র ৩.৪৭। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গায়ানা ও ল্যাঙ্কশায়ারের হয়ে পেয়েছেন ৪২৮ উইকেট, ২৫ গড়ে!

ওয়ানডেতে তাঁর সেরা রূপটা দেখা যায় কিংসটাউনে, সেবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২৭ রানে অল আউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাঁরপরও জেতে দুই রানের ব্যবধানে। কারণ, ক্রফট সেদিন নয় ওভার বোলিং করে চার মেইডেন সহ ছয় উইকেট পান। রান দেন মাত্র ১৫ টি!

ক্যারিবিয়ানদের ১৯৭৯ বিশ্বকাপ জয়ে বড় অবদান ছিল তাঁর। তিনি আট উইকেট নিয়েছিলেন সেই আসরে, মাত্র ১৭.৫০ গড়ে। ইকোনমি ছিল ৩.০৮!

কি বিরাট এক তারকার এত ছোট্ট ক্যারিয়ারের কারণ কী? কোনো রহস্য নয়, ৮০’র দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্রোহী সফরে যাওয়ায় যেসব কালজয়ী ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার ছোট হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের একজন হলেন ক্রফট। যদিও, তা নিয়ে কখনোই আক্ষেপ করেননি ক্রফট। বরং খুব বড় গলার বরাবরই বলে এসেছেন, ‘আই গেজ, মানি ইজ এভ্রিবডিস গড!’

যদিও, সেই বিদ্রোহী সফরে গিয়েই জীবনের অন্যতম ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন  হন ক্রফট। কেপ টাউনের এক ট্রেন কমপার্টমেন্ট থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয় স্রেফ কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে। সেই ঘটনা তখন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলে। ১৫ বছর বাদে ঘটনাটির জন্য দায়ী মূল দুই ব্যক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান ক্রফটের কাছে!

ব্যক্তিজীবনে কলিন ক্রফট পুরোদস্তর একজন অলরাউন্ডার। তিনি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার পাইলট। তিনি বার্কশায়ার স্কুলে অংকের মাস্টার ছিলেন। পড়াশোনায় বরাবরই নাকি ভাল ছিলেন ছোট বেলা থেকে। ক্রিকেটার হওয়ার বড় কোনো শখও ছিল না।

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি ক্রিকেটটা খেলতেই চাইনি। আমি হতে চাইতাম ইঞ্জিনিয়ার, হয়তো ডক্টরেটও করতাম। ক্রিকেটটা খেলে আমি সেসব করা থেকে বঞ্চিত হয়েছি, যা খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে আর করা সম্ভব নয়!’

ক্যারিয়ার শেষ করে তিনি লম্বা সময় ইএসপিএন ক্রিকইনফোর কলামিস্ট ছিলেন। বিসিবির টেস্ট ম্যাচ স্পেশালে কাজ করেছেন। তাঁর সাহসী ধারাভাষ্যে প্রায়ই তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনের ভয়ডরহীনতার ছোঁয়া পাওয়া যায়!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link