আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কত ব্যাড বয়ই তো এলেন। তবে আপনি যখন বাউন্ডারি রোপটার ভিতরে পা দিবেন তখন আপনি শুধুই ক্রিকেটার। নিজের ব্যক্তিগত জীবন যারা মাঠের বাইরে রেখে আসতে পারেন তাঁরা ব্যাডবয় হয়েও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পারফর্ম করেছেন। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, দর্শন কোনকিছুই মাঠের ক্রিকেটে প্রভাব পড়েনি। তবে মাঠ আর মাঠের জীবনটা মিলে মিশে গেলেই সব গেল! সে ভুলটাই করেছিলেন নাসির হোসেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটেও তো কত ব্যাডবয় এল। এমনকি খোদ সাকিব আল হাসানকে নিয়েও তো কত সমালোচনা হয়। কোনদিন বিজ্ঞাপন করছেন, কোনদিন অনুশীলন করছেন না, কোনদিন তিনি দলের সাথেই নেই। তবে সাকিব যখন মাঠে ঢোকেন তখন এই সবকিছুই বাইরে রেখে আসেন। বাইশ গজের সাকিবের দিকে আঙুল তুলবে, প্রশ্নবিদ্ধ করবে সেই সাহস কার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তো এমন চরিত্রের অভাব নেই।
বাংলাদেশ থেকে নাসির হোসেনও এমনই একজন হতে পারতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা তো তাঁর বড্ড বেশি পরিচিত ছিল। আর সেই বাইশ গজ থেকেই আজ তিনি কত সহস্র মাইল দূরে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তাঁর জন্য এখন প্রায় অসম্ভবে পৌঁছেছে।
নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মাঠের ক্রিকেটটা গুলিয়ে ফেলেছিলেন নাসির। একটু একটু করে কক্ষপথ থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশ তাঁকে নিয়ে কত বড় স্বপ্নই না দেখেছিল। বাংলাদেশের তো আরেকজন অলরাউন্ডার ছিল, নাসির হোসেন।
একজন কার্যকর ক্রিকেটার হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন – সবই তো ছিল রংপুরের ছেলে নাসিরের মধ্যে। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করতেন। বিপদে দেয়াল তুলে দাঁড়াতেন, খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে দলকে বিজয়ের নিশানা দেখাতেন। বলা হত, তিনিই নাকি বাংলাদেশের সেরা ফিনিশার, বাংলাদেশের মাইকেল বেভান। এখন এসব উপমা শুনলে হাস্যকর মনে হয়।
বোলিংয়ে কার্যকর ছিলেন, গুরুত্বপূর্ন সব সময়ে উইকেট এনে দিতে মুশফিক-মাশরাফিরা বারবারই ডাকতেন নাসিরকে। নাসির সেই ভরসার প্রতিদান দেননি – এমন নজীর খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফিল্ডিংয়ে ছিলেন ওই সময়ের সেরা। কি দারুণ রিফ্লেকশন, কি ডেডিকেশন। আর শারীরিক অভিব্যাক্তির কথা তো না বললেই নয়, তার মত আত্মবিশ্বাস মাঠে খুব কম খেলোয়াড়েরই থাকতো। অথচ ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ যখন খেলেছেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৭, একজন ক্রিকেটারের সবচেয়ে পরিণত বয়স। সেই নাসির কী আদৌ ফিরতে পারবেন, পথটা যে বড্ড কঠিন।
টেস্টের প্রায় ৩৫ গড়, কিংবা ওয়ানডেতে ৩০ গড় – কোনোটাই তো মন্দ নয়। দু’টি সেঞ্চুরি করেছেন, তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১৪ টি হাফ সেঞ্চুরি, ৩৯ টি উইকেট – এখানেই কেন নাসিরের এপিটাফ লেখার সময় চলে এল?
এই প্রশ্নের জবাবটা নাসিরই দিতে পারবেন। কারণ, পরিশ্রম করতে অনীহা, অতি-আত্মবিশ্বাসই তার এই পরিণতির কারণ। তার বিরুদ্ধে টিম ম্যানেজমেন্টের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল – তিনি একদমই মন দেন না অনুশীলনে। সময় মত আসেন না, ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে বললে করেন না।
আর ক্রিকেটের বাইরে তার এলোমেলো ব্যক্তিগত জীবন তো ছিলই। শৃঙ্খলাজনিত অনেক ইস্যুতে অনেকবারই নাসিরকে নিয়ে সরব ছিল গণমাধ্যম। গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচের আগেরদিন রাত করে টিম হোটেলে ফেরা, টিম মিটিংয়ে না থাকা – ইত্যাদি অসংখ্য অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে হরহামেশাই পাওয়া যেত।
সেজন্য নাসিরকে ২০১৮ সালের পর আর জাতীয় দলে নেওয়ার কোনো প্রসঙ্গই আর ওঠেনি। আর মাঠের পারফরম্যান্সেও তিনি এমন আহামরী কিছু করে দেখাতে পারেননি যে, ‘ব্যাড বয়’ ইমেজ ভেঙে তাঁর ক্রিকেটীয় চরিত্রকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে। তাই নাসির এক রকম চলে গেলেন বিস্মৃতির অতল গহবরে!
ঘরোয়া ক্রিকেট অবশ্য নাসির নিয়মিতই খেলছেন। এবারের জাতীয় লিগেও রংপুরের হয়ে মাঠে নেমেছেন। যদিও নিজেদের প্রথম ম্যাচের দুই ইনিংসে তাঁর স্কোর যথাক্রমে ১ ও ৫। বল হাতেও উইকেট শূন্য। যদিও অনুশীলনে এখন তাঁকে নিয়মিতই দেখা যায়। তবে এই সবকিছুই এখন যেন বৃথা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে নাসির হোসেন শুধুই এক আক্ষেপ। ফিনিশার নাসির হোসেন কখন যেন নিজেই ফিনিশ হয়ে গেলেন।