এমন গল্প পেলে বলিউডে ধুন্ধমার ছবি বানানো যেতে পারে। এমন পরিশ্রম, ত্যাগ, পরিশ্রম আর নাটকীয়তার গল্প তো আর বাস্তব জীবনে রোজ রোজ দেখতে পাওয়া যায় না।
থাঙ্গারাসু নটরাজন এমন এক দারিদ্র থেকে এসেছেন, যেখানে পরের বেলার খাবার জোটানোটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে ক্রিকেট নামক আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগ কোথায়!
নটরাজন স্বপ্নটা দেখতে পেরেছিলেন। ক্রিকেট তাঁর জন্য সব কিছু থেকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা। আর সেই রাস্তা ধরেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) হয়ে তিনি এখন ভারতীয় দলে। এই যাত্রায় আছে অনবদ্য সাহস, অনন্য গৌরব।
নটরাজনের বেড়ে ওঠা খুবই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তামিলনাড়ুর সালেম থেকে ৩৬ কিমি দূরের গ্রাম চিন্নাপ্পমপট্টিতে। সেখানে যাওয়ার পথ যতটা দুর্গম, তার চেয়েও বেশি বন্ধুর ছিল ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর উঠে আসার পথ।
নটরাজনের জন্ম ১৯৯১ সালের ২৭ মে। বাবা ছিলেন দিনমজুর। কখনো স্টেশনে কুলির কাজ করেন, কখনো কারখানায়। কোনোদিন সেটাও পান না। মা রাস্তার ধারে বসে মুরগি বিক্রি করেন। তাঁদের সামান্য আয় দিয়েই পাঁচ সন্তানের পেটে খাবার জোটে।
হ্যাঁ, এমন একটা পরিবারের ছোকড়াই ভয়ডরহীন কণ্ঠে বলে ফেলেছিলেন, ‘আমি ওভারের ছয়টা বলই ইয়র্কার করতে পারি!’
অথচ, গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়েও বই খাতা বা কলম-পেন্সিল কেনার পয়সা ছিল না। টেনিস বলে ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয় পাঁচ বছর বয়সে। সময় এগেলো, ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালবাসা বাড়লো। ক্রিকেটও একটা সময় সেই ভালবাসার প্রতিদান দিতে শুরু করলো।
নটরাজন স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোতে ক্রিকেটার হিসেবে ডাক পেতে শুরু করলেন। সেখানেও ছিল বিপত্তি, না ছিল যুৎসই পোশাক, না ছিল বোলিং করার জুতো। যাওয়া-খাওয়ার পয়সার কথা তো বাদই দিলাম। এই দারিদ্রের জ্বালাই বাইশ গজে উইকেটের বৃষ্টি নামালো।
তখনই জয় প্রকাশ নামের এক প্রতিবেশি ব্যবসায়ীর নজরে পড়েন তিনি। জয় প্রকাশই যেচে পড়ে নটরাজনের বাবা মাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এই ছেলের ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। পরিচর্যা পেলে আরো ভাল করা সম্ভব এই বিশ্বাসটা তিনিই বুনে দেন নটরাজনের মধ্যে।
নটরাজন সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পেরেছেন। তিনি মেন্টর মানেন জয় প্রকাশকে। আইপিএলে তাঁর শরীরে থাকা জার্সিতে লেখা থাকে ‘জেপি নাট্টু’। যার পুরো অর্থ হল – ‘জয় প্রকাশ নটরাজন’।
তামিল নাড়ুতে চতুর্থ বিভাগ ক্রিকেট খেলে শুরু হয় নটরাজনের যাত্রা। স্বপ্ন তখন আরেকটু বড়। টেনিস বল ছেড়ে তখন তিনি স্বপ্ন দেখছেন তামিল নাড়ুর হয়ে খেলার। স্বপ্ন পূরণও হয়ে যায় ২০১৪ সালে। তিনি ডাক পান রঞ্জি দলে।
থাঙ্গারাসু নটরাজনের আর থেমে থাকার সুযোগ কোথায়। প্রাদেশিক টি-টোয়েন্টি দল হয়ে বিজয় হাজারে ট্রফি খেলেন। এরপর তামিল নাড়ু প্রিমিয়ার লিগে (টিএনপিএল) নিজের জাত চেনন। সেখান থেকেই তিনি স্বপ্নের আইপিএলে, যে মঞ্চে বিশ্বের যেকোনো ক্রিকেটার খেলতে পারলেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন।
নাহ, যত সহজে লেখা গেল, তত সহজ ছিল না তাঁর উত্থান। চাকিংয়ের দায়ে এক বছরের জন্য তাঁকে নিষিদ্ধ করেছিল বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। মনোবল ভাঙতে দেননি নটরাজন। অ্যাকশন নিয়ে কাজ করেছেন। সাথে ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার সুনীল সুব্রামানিয়াম, ডি বসু ও এম ভেঙ্কটরামনেরা।
তিনি ফিরেছেন আরো প্রবল হয়ে, বিসিসিআইকে বাধ্য করেছেন আইপিএলে নিলামে রাখতে, দল পেয়েছেন, পারফরম করেছেন, টো ক্রাশিং ইয়র্কারে বিশ্বের অন্যতম সেরা টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্সকে ড্রেসিং রুমের পথ দেখিয়েছেন। তাই তো, ভারতীয় দলের নীল জার্সি এখন তাঁর শরীরে। এই জীবন সিনেমার চিত্রনাট্য নয়, তো কি!
তবে, অতীতকে একেবারে ভুলে যাননি নটরাজন। যাকে পাওয়ার জন্য আইপিএলের নিলামে কাড়াকাড়ি হয়, বড় বড় দলগুলো কোটি কোটি রুপির ডাক ছাড়ে, পোলার্ড-রোহিত-মর্গ্যানরা তাকে সামলে খেলেন, ওয়ার্নার-কোহলিরা যার ওপর আস্থা রাখেন – সেই নটরাজনের আজো প্রতিটা জুতো ব্যবহার করেন যত্নের সাথে। সামান্য একটা জুতোর জন্য একটা সময় কত দুয়ারে ঘুরেছেন, তিনিই তো এর মর্ম সবচেয়ে ভাল বুঝবেন।
এর মধ্যে নটরাজনের পরিবারে এসেছে সুদিন। অর্থাভাব নেই, বোনদের বিয়ে দিচ্ছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। নিজের পড়াশোনাটাও ক্রিকেটের জন্য বন্ধ রাখেননি। হিন্দি রপ্ত করেছেন স্বয়ং বীরেন্দ্র শেবাগের কাছ থেকে। নিজে বিয়ে করেছেন, ঘর আলো করে এসেছে কন্যা সন্তান।
লোকে বলে, কন্যা সন্তান নাকি সৌভাগ্যের প্রতীক। আইপিএল চলাকালেই বাবা হওয়ার খবর পান, একই আসর চলাকালেই ডাক পান জাতীয় দলে। ঠিক সিনেমার ‘হ্যাপি এন্ডিং’-এর মত!
‘ইকবাল’ ছবিটার কথা মনে পড়ছে খুব। শেষ দৃশ্যে উদ্বোধনী বলটা করার জন্য ছুটছেন ইকবাল খান। গ্যালারিতে বসা বাবা-মায়ের চোখে তখন অশ্রুধারা।
না, ক্যানবেরা গ্যালারিতে নটরাজনের পরিবারের কারো উপস্থিত থাকার সুযোগ ছিল না। কিন্তু, বাড়িতে বসে নিশ্চয়ই খেলা দেখেছেন সবাই। নিশ্চয়ই গর্বে সবার চোখেই পানি এসেছে।
নাহ, সিনেমার চেয়ে জীবনই সুন্দর!