দ্য লিজেন্ড অব নিল জনসন

ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ের সেই ‘সোনালী প্রজন্মের’ অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন নিল জনসন। তাঁকে মনে করা হয় জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবং ন্যাচারালি গিফটেড অলরাউন্ডার। ‘অ্যাগ্রেসিভ’ স্ট্রোকপ্লে আর বৈচিত্রময় মিডিয়াম পেস বোলিং দিয়ে যিনি জয় করেছিলেন অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়।

১৯৯৭-২০০২  এই সময়কালকে বলা হয় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ। যে সময়টায় জিম্বাবুয়েকে দেখা হত অত্যন্ত সমীহের চোখে, গণ্য করা হত বিশ্ব ক্রিকেটের ‘উঠতি পরাশক্তি’ হিসেবে; যারা ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে পৃথিবীর যে কোনো দলকে হারিয়ে দেয়ার যোগ্যতা রাখত। অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, মারে গুডউইন, স্টুয়ার্ট কার্লাইল, ফ্লাওয়ার ব্রাদার্সের মত ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ ব্যাটসম্যান; হিথ স্ট্রিক, পল স্ট্র্যাং, হেনরি ওলোঙ্গার মত ‘উইকেট শিকারি’ বোলার আর নিল জনসন, গাই হুইটাল, অ্যান্ডি ব্লিগনটের মত ‘কার্যকরী’ অলরাউন্ডার নিয়ে গড়া দলটা সত্যিকার অর্থেই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনন্য উচ্চতায়।

ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ের সেই ‘সোনালী প্রজন্মের’ অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন নিল জনসন। তাঁকে মনে করা হয় জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবং ন্যাচারালি গিফটেড অলরাউন্ডার। ‘অ্যাগ্রেসিভ’ স্ট্রোকপ্লে আর বৈচিত্রময় মিডিয়াম পেস বোলিং দিয়ে যিনি জয় করেছিলেন অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়।

১৯৭০ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন রোডেশিয়ার (জিম্বাবুয়ের পূর্বনাম ছিল রোডেশিয়া) সালিসবুরিতে (বর্তমান হারারে) জন্মগ্রহণ করেন নিল ক্লার্কসন জনসন। তবে জন্মের পরপরই বাবা-মায়ের সাথে পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়। ক্রিকেটের হাতে খড়িটাও হয়েছিল সেখানেই।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক মাত্র ষোল বছর বয়সে। খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের দল বোল্যান্ড, ইস্টার্ন প্রভিন্স, ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স আর নাটালের হয়ে। ১৯৯৪-৯৫ সালে একবার সুযোগ পেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলেও!

১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে জনসন চলে যান ইংল্যান্ডে। কাউন্টি দল লিস্টারশায়ারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। সেখানে দু’বছর খেলে ফিরে আসেন জিম্বাবুয়েতে। জন্মভূমির হয়ে খেলার অধরা স্বপ্নটা বাস্তবায়ন হতে অবশ্য একদমই সময় লাগেনি।

১৯৯৮ সালের ৭ অক্টোবর, হারারেতে ভারতের বিপক্ষে জনসনের টেস্ট অভিষেক। ব্যাট হাতে দুই ইনিংসেই ব্যর্থ হলেও (৪ ও ১) তিনি ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিলেন বল হাতে। প্রথম ইনিংসে ৬৪ রান খরচায় একটি আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৪১ রানের বিনিময়ে নেন তিনটি উইকেট। শেষ পর্যন্ত জিম্বাবুয়ে ম্যাচটি জিতেছিল ৬১ রানে।

এখানে না বললেই নয় যে, জনসনের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম উইকেটটা ছিল শচীন টেন্ডুলকারের।

একই বছর ডিসেম্বরে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে পাকিস্তান সফরে যায় জিম্বাবুয়ে। সেখানেই প্রথম বারের মত ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন সাবেক এই অলরাউন্ডার। ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরিটাও পেয়ে যান ওই সিরিজেই।

পেশোয়ার টেস্টে সতীর্থদের ব্যর্থতার মিছিলে ব্যাট হাতে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন নিল জনসন। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, আকিব জাভেদ আর সাকলায়েন মুশতাকের মত বোলারকে সামলেছিলেন শক্ত হাতে। খেলেছিলেন ১৬ বাউন্ডারিতে সাজানো ১১৭ বলে ১০৭ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। যে ইনিংসের সৌজন্যে জিম্বাবুয়ে পেয়েছিল ৭ উইকেটের অবিস্মরণীয় এক জয়! উল্লেখ্য, ওটাই ছিল ‘দেশের বাইরে’ টেস্ট ক্রিকেটে আফ্রিকান দেশটির প্রথম সাফল্য।

ক্রিকেটার হিসেবে নিল জনসনকে মানুষ কেন মনে রাখবে? তাঁকে মনে রাখার কেবল একটিমাত্র কারণ যদি থেকে থাকে, তবে সেটা অবশ্যই ’৯৯ বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের সপ্তম আসর মাতানো যে কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, তাঁরা হলেন ল্যান্স ক্লুজনার, শেন ওয়ার্ন, রাহুল দ্রাবিড়, স্টিভ ওয়াহ, জিওফ অ্যালট আর নিল জনসন। তা মনে রাখার মত কী এমন করেছিলেন জনসন? চলুন সে গল্পটাই একটু জেনে আসি।

জিম্বাবুয়ে ছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’। যারা ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাশক্তিকে হারিয়ে পেয়েছিল ‘জায়ান্ট কিলারের’ তকমা; প্রথম বারের মত, সুপার সিক্স রাউন্ডে কোয়ালিফাই করার মধ্য দিয়ে গড়েছিল ইতিহাস। আফ্রিকান দেশটির এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে ‘নেপথ্য কারিগর’ ছিলেন যারা, তাঁদের মধ্যে নিল জনসন অন্যতম। বিশেষ করে, গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে, ‘ডু অর ডাই’ সিচুয়েশনে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ‘ঐতিহাসিক’ বিজয়ে ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবেক এই অলরাউন্ডার।

পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ খেলা জনসন তিনটি ম্যাচে জিতেছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। আট ম্যাচে ৫২.৪ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৩৬৭ রান। এক সেঞ্চুরির সাথে হাফ সেঞ্চুরি ছিল তিনটি। পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ১২টি উইকেট। দলের পক্ষে একাধারে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও সর্বাধিক উইকেটশিকারি বোলার তিনিই ছিলেন।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে জনসনের উল্লেখযোগ্য কীর্তিগুলো ছিল দারুণ –

  • কেনিয়ার বিপক্ষে ৫৯ রান ও ৪২ রানে ৪ উইকেট।
  • দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৬ রান ও ২৭ রানে ৩ উইকেট (ইনিংসের প্রথম বলেই গ্যারি কার্স্টেন আর জ্যাক ক্যালিসের উইকেটসহ)।
  • সুপার সিক্সে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩২* রান ও ৪৩ রানে ২ উইকেট।
  • সুপার সিক্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫৪ রান ও ৩৯ রানে ১ উইকেট।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিল জনসনের উত্থান দেখে অনেকে মনে করেছিলেন হয়ত আরেকজন গ্রেট অলরাউন্ডার পেতে চলেছে ক্রিকেট বিশ্ব। কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, সব গল্পের শেষটায় মিলন হয় না। জনসনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। মাত্রই তিরিশের কোঠা পেরিয়েছেন, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে হঠাৎ অবসরের ডাক দেন তিনি।

২০০০ সালের ইংল্যান্ড সফরের পরপরই জনসনের আকস্মিক এই বিদায়ের পেছনে আসল কারণটা কী ছিল সেটা অবশ্য জানা যায়নি। তবে বোর্ডের সাথে বেতন নিয়ে বনিবনা না হওয়া, তৎকালীন কোচ ডেভ হটনের সাথে মতবিরোধ, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা – সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

জাতীয় দলের হয়ে না খেললেও ঘরোয়া ক্রিকেটে আরও কিছুদিন খেলা চালিয়ে গিয়েছেন জনসন। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে নতুন করে চুক্তিবদ্ধও হয়েছিলেন কাউন্টি দল হ্যাম্পশায়ারের সঙ্গে। সেখানে বছর চারেক খেলার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন তিনি। ২০০৪ সালে অবসরের পর স্থায়ীভাবে বসত গড়েন দক্ষিণ আফ্রিকায়।

জনসনের খেলা যারা স্বচক্ষে দেখেছেন তারা সবাই হয়ত একথা স্বীকার করবেন যে, নিজের দিনে তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার। আর জনসনের অলরাউন্ড সামর্থ্য নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান, উদ্বোধনী বোলার – নিল জনসনের অলরাউন্ডার সত্ত্বা বোঝাতে ব্যস এতটুকুই যথেষ্ট! জনসন ব্যাট করতেন বাম হাতে, কিন্তু বল করতেন ডান হাতে। বোলিংয়ে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল আউটসুইং।

নিল জনসনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স মাত্র দুই বছর। এরই মাঝে ওয়ানডে খেলেছেন ৪৮টি। যার প্রায় সবগুলোতেই ছিলেন ওপেনারের ভূমিকায়। ৩৬.৫০ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ১৬৭৯ রান। চারটি সেঞ্চুরির সাথে হাঁকিয়েছেন ১১টি হাফ-সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ইনিংস ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হার না মানা ১৩২ রান।

এছাড়া ওয়ানডেতে বল হাতে জনসনের ঝুলিতে আছে ৩৫ টি উইকেট। সেরা বোলিং ১৯৯৯ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে ৪/৪২।

ওয়ানডের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও বেশ উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। মাত্র ১৩ টেস্টে জনসনের সংগ্রহ ৫৩২ রান। ব্যাটিং গড় মাত্র ২৫; তবে বেশিরভাগ সময় ব্যাট করেছেন ৬/৭ নম্বরে। ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটি করেছিলেন ৬ নম্বরে নেমে, পেশোয়ারে পাকিস্তানের বিপক্ষে। এছাড়া টেস্টে তাঁর চারটি হাফ-সেঞ্চুরিও আছে।

টেস্ট ক্যারিয়ারে মাত্র নয় ইনিংসে বল হাতে নিয়েছেন জনসন। আর তাতেই টেন্ডুলকার, ক্যালিস, চন্দরপল, সাঈদ আনোয়ারের মত ব্যাটসম্যানের উইকেটসহ মোট শিকার ১৫ উইকেট। সেরা বোলিং ৭৭ রানে ৪ উইকেট, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

আর্ন্তজাতিক ক্যারিয়ার তেমন একটা দীর্ঘ না হলেও এই সীমিত সময়েই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে তিনি দিয়েছেন অনেক কিছু। তাই কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে জনসনের মত প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে বিচার করাটা বোধ হয় উচিত হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link