খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন নিউজিল্যান্ডকে প্রতিপক্ষ হিসেবে কোনো ফরম্যাটেই চূড়ান্ত বড় দলগুলো ঠিক পাত্তা দিত না। হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ড নিয়মিত জয় পেত বটে, তবে ঠিক বিরাট বড় দল হয়ে উঠছিল না তাঁরা। ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালও যখন খেলতে নামে তখন অস্ট্রেলিয়াই ছিল স্পষ্ট ফেবারিট।
তবে, ধারাবাহিকতায় তাঁরা একটা শক্ত জায়গা গড়ে তুলতে পেরেছে ক্রিকেট বিশ্বে। তারই সিঁড়ি বেয়ে দলটি এখন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। তবে, নিউজিল্যান্ডের ফাইনাল খেলার পথটা কী খুব সহজ ছিল? অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলগুলোকে পিছনে ফেলে আসার পথটা মোটেই সহজ হবার কথা নয়।
অথচ কয়েকবছর আগেও ক্রিকেট মাঠে বেশ খারাপ সময় পার করছিল দলটি। সেখান থেকে নিউজিল্যান্ড ফিরে এসেছে দুইজন অধিনায়কের হাত ধরে। এই দুইজনের নেতৃত্বের ধরণ আলাদা তবে তাঁদের জন্যই নিউজিল্যান্ডের এই সাফল্য।
২০১২-১৩ সালেও ক্রিকেট মাঠে খুব একটা ভালো সময় পার করছিল না নিউজিল্যান্ড। সেই সময় টানা পাঁচটি টেস্ট ম্যাচ হারে দেশটি। ১৯৫০ সালের পর নিউজিল্যান্ড সেই প্রথম এই ভরাডুবি দেখলো। ২০১৩ সালে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বে প্রথম টেস্ট খেলতে নামলো দলটি। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্টেই মুখোমুখি হলে সেই সময়ে টেস্ট র্যাংকিংয়ের এক নম্বর দল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।
কেপ টাউনে টেস্টের প্রথম দিন সকালে ব্যাট করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন কিউই অধিনায়ক। প্রথম দিন সকালে ২০ ওভার হওয়ার আগেই মাত্র ৪৫ রানে অল আউট হয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। ম্যাককালাম অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম টেস্টেই হেরেছিলেন ইনিংস ব্যবধানে। সবমিলিয়ে কোনোভাবেই একটা দল হিসেবে খেলতে পারছিল না কিউইরা।
সেই সময় অভিযোগ উঠতো নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা নাকি স্বার্থপরের মত ক্রিকেট খেলতেন। একজন ব্যাটসম্যান ৩০-৪০ রান করলেই ভাবতেন আমার কাজ শেষ। পরের ম্যাচে জায়গা নিশ্চিত করাই যেনো ক্রিকেট খেলার একমাত্র উদ্দেশ্য।
পরের বছর নভেম্বরে পাকিস্তানের সাথে টেস্ট খেলতে যায় নিউজিল্যান্ড। সিরিজ হারের পর শেষ ম্যাচে মাঠে নামার জন্য অপেক্ষা করছিল নিউজিল্যান্ড দল। সেই সময়েই কালো মেঘ নেমে এলো ক্রিকেট দুনিয়ায়। বলের আঘাত পেয়ে সেদিন মারা যান ফিল হিউজ। নিউজিল্যান্ড দলের ক্রিকেটাররা মানসিসভাবে একেবারেই ভেঙে পড়ে। একটা টেস্ট ম্যাচ খেলার মত অবস্থায় আর কোনো ক্রিকেটার ছিলেন না। ফলে ওইদিন মাঠে না নামার কথাও একবার বলেছিল নিউজিল্যান্ড দল।
পরে নিউজিল্যান্ডের সাইকোলজিস্টকে ডেকে আনা হয়। তিনি বলেছিলেন সব স্কিল, পরিকল্পনা ভুলে যেয়ে একটা দিন শুধু উপোভগ করার জন্য খেলতে। নিউজিল্যান্ড সত্যিই কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই মাঠে নেমেছিল। যে যেভাবে খেলতে চেয়েছে সেভাবেই খেলেছে। বোলাররা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো বাউন্সারও দেননি হিউজকে স্মরণ করে। ম্যাকক্যালাম ফিল্ডিং সাজিয়েছিলেন মনের মত। চারজন স্লিপ, দুইজন গ্যালিতে ফিল্ডিং করছিল। উইকেটের পিছনের ছিল মোট ৮ জন ফিল্ডার।
তবে প্রথম দিন শেষে পাকিস্তান মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে করে ২৮১ রান। পরের দিনে সকালে মাত্র ৭০ রান দিয়েই পাকিস্তানের শেষ সাত উইকেট তুলে নিয়েছিল নিউজিল্যান্ডের বোলাররা। ব্যাট করতে নেমে ম্যাককালাম খেলেছিলেন ১৮৮ বলে ২০২ রানের এক ইনিংস। কেইন উইলিয়ামসন যোগ করেছিলেন ১৯২ রান। সবমিলিয়ে ৪.৮১ স্ট্রাইকরেটে নিউজিল্যান্ড করেছিল ৬৯০ রান। সেই ম্যাচে ইনিংস ও ৮০ রানে জিতেছিল কিউইরা।
এরপর ম্যাককালামের নেতৃত্বেই ২০১৫ বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছিল নিউজিল্যান্ড। ফাইনাল ম্যাচটি বাদে ওই বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচ জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। সেই থেকেই আবার নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট জাগরণ হলো। তবে বিশ্বকাপের পরেই ম্যাককালাম ক্রিকেটকে বিদায় জানালে আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে দেশটি। সেই সময় উইলিয়ামসনকে অধিনায়কত্ব দেয়ার ব্যাপারে সবাই একমত ছিল না অবশ্যই। তবে সেই বাজিটা ধরেছিল নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট। তবে সেই বাজিতে বড় জয়ই হয়েছে নিউজিল্যান্ডের।
২০১৩ সালে ম্যাককালাম যখন দলটি হাল ধরেন তখন টানা টেস্ট হারের পাশাপাশি ওয়ানডে র্যাংকিং এর ৯ নম্বরে নেমে এসেছিল দলটি। টি-টোয়েন্টি র্যাংকিং ও ছিল ৮ নম্বরে। সব মিলিয়ে ভেসে যেতে থাকা একটি দলের দিকে হাত বাড়িয়ে পাড়ে তুলেছিলেন ম্যাককালাম।
তবে, ম্যাককালাম চেয়েছিলেন নিউজিল্যান্ড এবার নতুন করে পথচলা শুরু করুক নতুন কারো হাত ধরেই। সে তাঁর দায়িত্ব পালন করে ফেলেছে। এক সাক্ষাৎকারে ম্যাককালাম বলেছিলেন, ‘আমি দলে আগ্রাসন ও আত্মবিশ্বাস যোগ করতে পেরেছিলাম। তবে আমার সময় দল কখনোই এতাটা ধারাবাহিক ছিল না। কেইনের নেতৃত্বে সেটা সম্ভব হয়েছে।‘
সত্যিই কেন উইলিয়ামসন নিউজিল্যান্ডকে নতুন করে পথচলা শিখিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে ২০১৯ বিশ্বকাপেরও ফাইনাল খেলে কিউইরা। ফাইনাল ম্যাচেও নানা নাটকীয়তাও ও ভাগ্যের গড়াকলে পড়ে শেষ মুহূর্তে হারতে হয় দলটিকে। তবে কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ড।
এরপর এতগুলো ক্রিকেট পরাশক্তিকে পিছনে ফেলে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠে উইলিয়ামসনরা। তখনও অবশ্য মনে হচ্ছিল না নিউজিল্যান্ড শিরোপার দাবিদার। ফাইনালে প্রতিপক্ষ যে স্বয়ং ভারত। কিন্তু, মাঠের লড়াই বলল ভিন্ন কথা। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতকে নিয়ে একরকম ছেলেখেলাই করলো নিউজিল্যান্ড। টেস্টের সর্বোচ্চ শিরোপাধারী এখন নিউজিল্যান্ড।
একই বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালও খেলে নিউজিল্যান্ড দল। সর্বশেষ তিনটা আইসিসি ইভেন্টের তিনটিতেই ফাইনাল খেলে একটা শিরোপা – এই সময়টা যে নিউজিল্যােন্ডের, সেটা বুঝতে আর কোনো তথ্য না দিলেও চলে!