বিসিবির অভিধানে ‘ব্যাকআপ’ ও ‘পরিকল্পনা’ শব্দগুলো নেই

রাত পোহালেই শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের এশিয়া কাপ মিশন। এবারের এশিয়া কাপ মিশন আবার যেন-তেন মিশন নয়, ভক্ত-সমর্থক থেকে শুরু করে খেলোয়াড় কিংবা বোর্ড কর্তারা বড় গলায় শুনিয়েছেন, এশিয়া কাপ জিততে চাই। কেউ কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও দেখছেন।

তবে এশিয়া কাপ শুরুর একদিন আগেই সেই স্বপ্ন ফিঁকে হতে শুরু করেছে। তামিম ইকবালের ইনজুরি দিয়ে শুরু (অবসরের ঘটনা ইচ্ছাকৃতভাবেই বাদ দিয়ে যাচ্ছি), আপাতত শেষ হচ্ছে এবাদতের ইনজুরি হয়ে লিটনের অসুস্থতায়। প্রত্যেকটা ইনজুরি বা অসুস্থতা জানিয়ে দিচ্ছে, আমাদের পরিকল্পলায় কত বড় গলদ ছিল!

ইনজুরি খুবই অনভিপ্রেত ঘটনা। সকল ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার পরেও যে কারো ইনজুরি ঘটতে পারে, অসুস্থও হতে পারেন। সেখানে টীম ম্যানেজমেন্টের খুব বেশি দায় দেয়ার সুযোগ নেই। সতর্কতার জন্য টিম ম্যানেজমেন্ট ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়দের ভিন্ন ধরনের ফিজিক্যাল ট্রেইনিং, ফিল্ড ট্রেইনিং এবং ওয়ার্ক লোড ম্যানেজমেন্টের আওতায় নিয়ে আসেন।

তারপরেও সবসময় ইনজুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বিকল্প খেলোয়াড় তৈরি রাখতে হয়। বড় টুর্নামেন্টে যাওয়ার আগে তাদের সুযোগ দিয়ে দিয়ে তৈরি করতে হয়।

বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট এখানে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বিকল্প ভাবতে পারেন নি। ফলে এক একজন ব্যাটারের ইনজুরির কারণে দলে যুক্ত হচ্ছেন আনকোরা নতুন খেলোয়াড়।

শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার আগে, অধিনায়ক-কোচ সংবাদ সম্মেলনে বলে গেছেন, এবাদতের ইনজুরি দলকে বেশ ভোগাবে। কিন্তু সত্যটা হলো, এবাদতের ইনজুরি দলকে ততটা ভোগাবে না, যতটা তামিমের ইনজুরি, লিটনের অসুস্থতা কিংবা অন্য যে কোন পজিশনের ব্যাটারের ইনজুরি ভোগাবে।

ওয়ার্ক লোড ম্যানেজমেন্ট কিংবা ফাস্ট বোলারদের ইনজুরি প্রবণতার কারণে বিশ্রাম দিয়ে খেলানোর যেই পরিকল্পনা, সেখানে অ্যালান ডোনাল্ড সফল। দলে ৫ জন ফাস্ট বোলার তৈরি হয়েছে, যার যে কোন ৩ জনকে খেলিয়ে দেয়া যায় এবং ফলাফল বের করে আনা যায়।

এভাবে পারফর্ম করার বোলার তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে। এবাদতের ইনজুরি খুব একটা প্রভাব ফেলছে না। দলে ৪ জন পরীক্ষিত ফাস্ট বোলার রয়েছে। প্রত্যেকে বড় টুর্নামেন্ট খেলার আগে দলের হয়ে পারফর্ম করে এসেছেন, একাধিক ম্যাচ জিতিয়ে এসেছেন।

ব্যাটিং বিভাগের জন্য একই কথা বলা যাচ্ছে না। ২০১৯ বিশ্বকাপ থেকে ২০২৩ বিশ্বকাপের মধ্যবর্তী এই ৪ বছরে টপ অর্ডারের কোন বিকল্প তৈরি করা হয় নি, মিডল অর্ডারের কোন বিকল্প তৈরি করা হয় নি। এক তামিমের ইনজুরিতেই দলে দুইজন টপ অর্ডার ব্যাটার নিতে হয়েছে যাদের একজনের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় নি, অপরজন দুই দফায় ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন চারটি।

এবার লিটনের অসুস্থতায় বিজয় এশিয়া কাপের মত টুর্নামেন্টে খেলবেন প্রায় এক বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলেই। অর্থাৎ এশিয়া কাপের মত মঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে ইনিংস উদ্বোধন করবেন এমন দুইজন ব্যাটার, যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরীক্ষিত পারফর্মার নন।

গত চার বছরে টপ অর্ডারে বিকল্প খেলোয়াড় হিসেবে বিজয় সুযোগ পেয়েছেন ৭-৮ ম্যাচ, নাঈম দুই দফায় ৪ ম্যাচ, রনি ১ ম্যাচ। জাকির দলে ডাক পেয়ে ইনজুরির কারণে ছিটকে গিয়ে আর ফিরতেই পারে নি। এভাবে বিকল্প খেলোয়াড় তৈরি হবে?

ক্রিকেট বিশ্বের কোথাও এভাবে বিকল্প খেলোয়াড় তৈরি হয় না। যে কোন পজিশনের জন্য একটা খেলোয়াড়দের গ্রুপকে নির্ধারণ করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ বা সিরিজে তাদের সুযোগ দিয়ে গড়ে তোলা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে দলের সাথে থেকে, ম্যাচের মধ্যে থেকে, একজন খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক মঞ্চে পারফর্ম করার জন্য উপযুক্ত হন। দলকে ম্যাচ জেতাতে ভূমিকা রাখেন। বড় টুর্নামেন্টগুলোতে সেই পোল থেকে খেলোয়াড় বাছাই করা হয়।

কিছুটা আগ বাড়িয়ে বলে রাখি, রিয়াদকে নিয়ে জলঘোলা যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্যও দায়ী টিম ম্যানেজমেন্ট। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকেই ২০২৩ বিশ্বকাপের পরিকল্পনা শুরু করার কথা। তখন থেকেই তারা জানেন, ২০২৩ সালে রিয়াদের বয়স হবে ৩৮ বছর এবং তিনি খেলার মত অবস্থায় নাও থাকতে পারেন। তার ব্যাকআপ প্রস্তুত করার পরিকল্পনা নেয়ার কথা তখন থেকেই। সেটা কোনো ভাবেই ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে হতে পারে না।

বিশ্বকাপের ৫ মাস আগে বিকল্প খেলোয়াড় নিয়ে পরিকল্পনা আপনাকে এশিয়া কাপের মত টুর্নামেন্টে ফিনিশার হিসেবে অনভিষিক্ত শামিম এবং আড়াই বছর আগে তিন ওয়ানডে খেলা শেখ মেহেদীকে নিয়ে যেতে বাধ্য করবে। সমর্থকরাও ফুসে উঠবেন। এশিয়া কাপের মত আসরে, একজন প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়কে বাদ দেয়া হচ্ছে এমন খেলোয়াড়দের উপরে ভিত্তি করে, যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত খেলতেই পারেন নি।

হুট করে এশিয়া কাপ বা বিশ্বকাপের মঞ্চে একজন তানজিদ তামিম, শামিম পাটোয়ারি কিংবা শেখ মেহেদীকে খেলিয়ে দেয়া, তাদের উপরেও বাড়তি চাপ প্রয়োগ করে। সমর্থকদের বড় ট্রফি জয়ের প্রত্যাশা, ভালো পারফরম্যান্স দেখার প্রত্যাশা এবং বড় খেলোয়াড়কে রিপ্লেস করার চাপ, এই খেলোয়াড়দের উপরে চেপে বসাই স্বাভাবিক।

কয়েক মাসের বদলে পরিকল্পনার কাজটি যদি দুই বছর আগে শুরু করা হতো, শামিম, মেহেদীরাও তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেতেন, দলে জায়গা নিয়েও প্রশ্ন তোলার জায়গা থাকতো না। কেবলমাত্র প্রার্থনাই করা যায়, তারা যেন সফল হতে পারেন। কিন্তু দল এবং খেলোয়াড়দের এই পরিস্থিতিতে ফেলার দায় সম্পূর্ণই বিসিবির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link