২০০৮ সালের এপ্রিল মাস। চেন্নাইয়ের এক তপ্ত বিকেল। এক দল তরুণ যুবক চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে অনুশীলন করছিলেন। সেখানে ছিলেন ২১ বছর বয়সী এক তরুণও। পরবর্তীকালে মিস্টার আইপিএল নামে খ্যাতি পাওয়া ভারতের অন্যতম সেরা ক্রিকেটারটি হলেন সুরেশ রায়না। তখনও মাত্র ক্যারিয়ার শুরু রায়নার। ভবিষ্যৎ তারকা খ্যাতি তো ছিলই। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) উদ্বোধনী আসরেই চেন্নাই সুপার কিংস তাঁকে দলে ভেড়ায়। দল পেয়েই বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন এই তরুণ তারকা।
তখন এক সাক্ষাৎকারে রায়না বলেছিলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ চেন্নাই আমাকে সুযোগ দিয়েছে। আমি আমার সেরাটাই দিব দলের জন্য।’ বোঝা যাচ্ছে, পারফর্ম করাটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন তিনি।
এর পরের দশ বছর উত্তর প্রদেশের এই তারকা চেন্নাইয়ের হয়ে আইপিএলে মাঠ মাতান। আইপিএলের তরুণ সম্ভাবনাময় থেকে বনে গেছেন ‘মিস্টার আইপিএল’। চেন্নাইয়ের হয়ে ১৭৬ ম্যাচে করেছেন ৪৬৮৭ রান। জাতীয় দলের হয়েও দিয়েছিলেন নিজের সেরাটা। দেশের হয়ে জিতেছেন বিশ্বকাপের শিরোপা।
ভারতের ২০১১ বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল সুরেশ রায়নার। ২০১৬ ও ২০১৭ আসরে নিষেধাজ্ঞার কারণে চেন্নাই ফ্র্যাঞ্চাইজি আইপিএলে না থাকায় ওই দুই বছর গুজরাট লায়ন্সের হয়ে খেলেছেন তিনি। এছাড়া পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে লেগে ছিলেন চেন্নাইয়ের সাথেই!
আইপিএলের অন্যতম সেরা এই তারকা চলতি বছর, মানে ২০২২ সালের আইপিএলের নিলামে ছিলেন অবিক্রিত। দু’বার নিলামে নাম তোলা হলেও রায়নাকে নিতে আগ্রহ দেখাননি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি! গেল আসরেও চেন্নাইয়ের হয়ে সব ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি তিনি।
আসলে, সুযোগ দেওয়ার সুযোগও ছিল না চেন্নাইয়ের হাতে। ব্যাট হাতে ছিলেন একদম সাদামাটা। চিরচেনা রায়নাকে মিস করছিলেন ভক্ত-সমর্থকরাও। তবে প্রত্যাশা ছিল ২০২২ সালের আসরে দশ দলের কোনো কোনো দলে জায়গা করে নেবেন এই তারকা। কিন্তু, সেটা আর হয়নি শেষ অবধি।
বলতে গেলে আইপিএলের শেষ দেখে ফেলেছিলেন রায়না। ৩৫ বছর বয়সী এই তারকা হয়ত আর ফিরতে পারবেন না আইপিএলে – এই বাস্তবতাটা অনেকটা মেনেই নিয়েছিলেন তিনি। নতুন করে তিনি আর তাই আইপিএল কেন, ক্রিকেটের কোনো লড়াইয়েই ফিরতে চান না। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে সকল ফরম্যাট থেকে ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
সেবার আম্বাতি রাইডু, মহেন্দ্র সিং ধোনি, ডোয়াইন ব্রাভো, রবিন উথাপ্পাদের বয়স ৩০’ এর বেশি হলেও দল পেয়েছেন সহজেই। তবে ভাগ্য সহায় হয়নি রায়নার! এমনকি দীর্ঘসময় খেলা চেন্নাই সুপার কিংসও তাঁকে নিতে বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ দেখায়নি।
আগ্রহ দেখাবে কি করে, নিজের শেষ আসরে যে ১২ ম্যাচে মাত্র ১৭.৩৮ গড়ে রান করেছেন রায়না! বাজে ফর্মের কারণে বাদ পড়লেও অধিনায়ক ধোনি অবশ্য মিডিয়ায় জানিয়েছিলেন ইনজুরির কারণে দলে নেই রায়না। ধোনি-রায়নার জুটি চেন্নাই সুপার কিংসকে দশ বছরে দিয়েছে অনেক কিছু।
২০১৫ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রায়না ও ধোনির দুর্দান্ত জুটিতে জয়ের পর ধোনি বলেছিলেন, ‘আমরা জানি আমাদের খেলাটা কিভাবে শেষ করতে হবে। আমাদের একজন আরেকজনের বোঝাপড়া বেশ ভাল। কার কাছে কি প্রত্যাশা সেটাও আমরা জানি।’
তাঁদের এই জুটি নিয়ে অবশ্য সন্দেহের কারণ নেই। দু’জনের বন্ধুত্ব এবং বোঝাপড়া দুটোই ছিল বেশ ভাল। ২০২০ সালে হুট করেই যখন ধোনি ঘোষণা দিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের! এর ঘন্টাখানেকের মাঝেই বন্ধুকে সমর্থন জানিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান রায়নাও!
এরপরই দুবাইতে আইপিএলের আগ মূহুর্তে রায়নার দল ছেড়ে দেশে ফিরে আসার ব্যাপারেও স্পষ্টভাবে খোলাসা করেননি কেউই। ২০২১ আসরে পুনরায় রায়নাকে দলে রিটেইন করাটাও ছিল বেশ অবাক ব্যাপার। ধোনির কারণেই রায়না দল পেয়েছেন এমন গুঞ্জনও অবশ্য ছিল!
চেন্নাই সুপার কিংসের বোলিং কোচ লক্ষ্মীপতি বালাজি বলেন, ‘ও আমাদের জন্য একজন ম্যাচ উইনার ছিল। আমার মনে আছে ২০০৮ সেমিফাইনালে পাঞ্জাবের বিপক্ষে রায়নার সেই অসাধারণ ইনিংসটা। সে চেন্নাই সুপার কিংসের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় কোনো সন্দেহ নেই।’
২০২১ সালের আইপিএল আসরে ব্যাট হাতে নিজের সেরাটা দিতে পারলে হয়তো সুযোগ আসতো ২০২২ আসরেও। হয়তো চেন্নাইয়ের হয়ে সেরাটা দিয়ে শেষটা সুন্দরভাবেই বিদায় নিতে পারতেন রায়না। সেটা হয়নি, এর মধ্যে বেশ কম বয়সেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহটাও হারিয়ে ফেলেছেন। সব গল্পের শেষটা যে সুন্দর হয়না!
তবে, রায়নার গল্পটা এখনই পুরোপুরি ফুরোচ্ছে না। বিদায়ের ঘোষণা দিয়েই তিনি বলে দিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে এখন তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে বেড়াবেন। বেশ অনেক জায়গা থেকে প্রস্তাবও আছে তাঁর টেবিলে। তাহলে কি এবার রায়না ২.০। এই যাত্রার শেষটায় যেন আক্ষেপ লেখা না থাকে!