বর্তমান সময়ে উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে বাংলাদেশের সেরা উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহান। ব্যাট হাতে এখনো নিজেকে সেভাবে প্রমাণ করতে না পারলেও গ্লাভস হাতে দুর্দান্ত পারফরম করে নিজেকে প্রমাণ করেছেন সেরাদের একজন হিসেবেই। ক্যারিয়ারের একটা সময় কিপিং ছেড়ে পেস বোলারও হতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোচের পরামর্শে পরবর্তীতে গ্লাভসকেই আবার আপন করে নেন তিনি। এ সব কিছু নিয়েই তিনি কথা বলেছেন ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ক্রিকবাজে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে।
- আপনি কিভাবে একজন উইকেটরক্ষক হলেন?
আমি ছোটবেলা থেকেই উইকেটকিপিং করি। সিনিয়রদের সাথে টেনিস বল ক্রিকেট খেলতাম। আমি ছোট ছিলাম বড়দের মতো দ্রুত দৌড়ে যেতে পারতাম না বলে আমাকে কিপার রাখতো। আমি যখন ক্রিকেট বলে অনুশীলন শুরু করি, তখন আমি কিপিং করতাম। কিন্তু বল আমার মুখে এবং শরীরে এসে লাগতো।
এরপর আমি নিজেকে পেসার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলাম। অনূর্ধ্ব ১৩ তে আমি পেসার হিসেবে খেলেছি! কিন্তু খুলনা অ্যাকাডেমির কোচ প্রয়াত শেখ সালাউদ্দিন স্যার আমাকে বলেছিলেন পুনরায় কিপিংয়ে ফিরে যেতে। তখন থেকেই আমি কিপিং করি।
- কিপিংকে মাঝে মাঝে ‘থ্যাঙ্কলেস জব’ বলা হয়?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি যখন কোনো স্টাম্পিং বা ক্যাচ মিস করবেন আপনার উপর পুরো দায়টা আসবে। একজন কিপারকে টি-টোয়েন্টিতে ১২০ বল ওয়ানডেতে ৩০০ বল ও টেস্টে পুরো দিন বলের দিকে নজর রাখতে হয়। কিন্তু অন্য জায়গায় ফিল্ডিং করলে কিছুটা বিশ্রাম পাওয়া যায়। এতো কিছুর পরেও একটা ভুলের জন্য কিপারকেই দায়ী করা হয় সবসময়ই।
- আপনি কিভাবে কোনো ক্যাচ বা স্টাম্পিং মিসের পর আবার খেলার মনোযোগ ফেরান?
এটা অবশ্যই হতাশার যখন আপনি কোনো ক্যাচ মিস করেন কিংবা স্টাম্পিং। কিপার হিসেবে আমি যদি আমার ভুলগুলোর দিকে মনোযোগী হই তাহলে আমি পরের বলে মনোযোগ দিতে পারবো না। তখন পরের বলটা মিস করার ৯০% সম্ভাবনা থাকবে। তাই আমাকে আগের ভুলটা ভুলে যেতে হয়।
আমি আমার ভুলগুলো নিয়ে কখনো ভাবিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করি আমি আমার ভুলগুলো দুর্দান্ত কোনো ক্যাচ বা স্টাম্পিং দিয়ে কভার করবো ওই ম্যাচেই। আমার জন্য, যখন আমি কোনো ক্যাচ বা স্টাম্পিং মিস করি তখন আমি আরো উদগ্রিব হয়ে উঠি এটা কভার করার জন্য।
- উপমহাদেশে ও উপমহাদেশের বাইরে কিপিং করার পার্থক্য কি?
হ্যাঁ, উপমহাদেশে এবং এর বাইরে কিপিং করা দুইটা ভিন্ন ব্যাপার। ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ অথবা নিউজিল্যান্ডে কিপিং করা কঠিন। কারণ সেখানে বল রিভার্সে যায়, স্টাম্প ক্রস করার পর স্যুইং হয়। কন্ডিশন ভেদে তাই সেখানে কিপিং করাটা কঠিন। তবে এশিয়ায় বলগুলো কিছুটা লো হওয়ায় এখানে কিপিং করাটা সহজ।
- একবার আপনি বলেছিলেন আপনার কিপিংয়ে উন্নতির জন্য মহেন্দ্র সিং ধোনি বেশ ভূমিকা রেখেছে। সেই গল্পটা বলুন….
সত্যি বলতে আমরা ছোট থেকে শিখেছি বল পিচ করা পর্যন্ত উইকেটের পেছনে বসে থাকতে হবে এবং বল পিচ করার পর উঠে দাঁড়াতে হবে। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বলের দিকে নজর রাখা। বলের ম্যুভমেন্ট বুঝতে পারলে আমার জন্য সহজ হবে কাজটা। কারণ স্পিনে যেকোনো সময় টার্ন করতে পারে কিংবা পেসের ক্ষেত্রে স্যুইং হতে পারে বল। সেক্ষেত্রে বল পিচ করার আগে বুঝতে হবে যে কোন দিকে বল ম্যুভ করতে পারে। আমি ধোনির থেকেও কিছু পরামর্শ নিয়েছি।
কারণ এশিয়ার মধ্যে সেই প্রথম কিপার যে কিপিং স্টাইলটা পরিবর্তন এনেছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ও এশিয়া কাপে আমি ধোনির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। কিপিং নিয়ে কথা বলেছিলাম। আমি তাঁর কথার সাথে একমত হয়েছিলাম যে, শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত বলের দিকে নজর থাকতে এবং বুঝতে হবে বল কোনদিকে ম্যুভ করবে। বল যেকোনো সময় ব্যাটারকে বিট করতে পারে। আমাকে অবশ্যই উইকেটের পেছন থেকে বলের ম্যুভমেন্ট নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ একটা বল বিট হওয়ার পর কিপার খুবই কম সময় পায় সেটা ধরার জন্য।
- আপনি প্রথাগত কিপিং পদ্ধতি থেকে নিজেকে কিপিংয়ে আরো সক্রিয় করার জন্য চেষ্টা করছেন?
আমরা অল্প বয়স থেকেই শিখেছি বল ধরার পর শরীরের লাইনে এনে তারপর স্টাম্প ভাঙতে হবে। তবে এখনকার সময়ে জশ বাটলার এবং অন্যান্য অনেক কিপারই এসব রীতি ফলো করে না। আগে ইংল্যান্ডও গতানুগতিক কিপিংয়ের নিয়ম অনুসরণ করতো। আমি একসময় অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে অনুসরণ করতাম। তবে এখনকার সময়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্টাম্পিং করতে হয়। নাহলে ওই সময়ের মধ্যে ব্যাটার আবার ক্রিজে পৌঁছে যাবে।
ধোনি প্রথম কিপার যে বল ধরার সাথে সাথেই স্টাম্প ভেঙে দেন পজিশন যেভাবেই থাকুক। একজন কিপার যেহেতু মাঠের মাঝখানে থাকে তার জন্য সবকিছু নজরে রাখাটা জরুরি। একজন কিপার ব্যাটারকে সবচেয়ে ভালো অনুসরণ করতে পারে বাকিদের চেয়ে। এটা একজন কিপারের দায়িত্ব ব্যাটারের অবস্থান, চিন্তাধারা নিয়ে বোলারের সাথে আলোচনা করা। সক্রিয় থাকার মানে হচ্ছে কিপারকে আগে থেকেই পূর্বানুমান করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
চট্রগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সে পল নিক্সনের কাছ থেকে শিখেছি যে প্রতিটা বলই এজ হচ্ছে, প্রতিটা বলই অফ স্টাম্প বা লেগ স্টাম্পে আমাকে ক্যাচ ধরতে হবে এমনটা ভাবতে হবে। মাঝেমধ্যে প্রথম স্লিপে ক্যাচ ধরাটা কঠিন কারণ এজ হওয়ার পর কিপারের খুব কম সময় থাকে সেটা তালুবন্দি করার। আমি যদি প্রতি বলে চিন্তা করি যে এজ হচ্ছে তাহলে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারবো। আমি সবসময়ই চেষ্টা করি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলকে নজরে রাখা।
- মুস্তাফিজের বিপক্ষে কিপিং করাটা কেমন কঠিন?
মুস্তাফিজ অসাধারণ একজন বোলার। আমি সবসময়ই শেষ মুহূর্ত অবধি বল অনুসরণ করি। আমি সাধারণত বোলিং গ্রিপ ফলো করিনা। আমি তখনি প্রেডিক্ট করতে চেষ্টা করি যখন বল রোলিং করছে। মুস্তাফিজ যখন বল করে, সে সাধারণত কাটারই মারে। এবং আমি মনে করি আমি তাঁর অন্য ভ্যারিয়েশনের বলগুলোও ভালোভাবে রিড করতে পারি। একটা সময় তাঁর অনেকগুলো ভ্যারিয়েশন ধরা খুব কঠিন হতো। তবে আমার জন্য কোনো কিছুই খুব সহজ কিংবা কঠিন না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত বলকে নজরে রাখা।
- আপনার সমালোচকরা বলে আপনি বেশ টকেটিভ কিপার….
আমি উইকেটের পেছনে সবসময়ই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি। এটা আমার স্বভাবসুলভই। মাঝেমধ্যে আমি একটা ক্যাচ মিস করে খুবই মন খারাপ করি। কিন্তু পরক্ষনেই আমি চিন্তা করি যে ক্যাচ মিস তো খেলারই অংশ। তবে আমার একটা দায়িত্ব হলো আমার দলের সবাইকে উজ্জীবিত রাখা। আমি শুধু চেষ্টা করি এটা করে যাওয়ার।