আগের বিশ্বকাপে ব্রাত্য, এবারের বিশ্বকাপের জাত্য। অলিভার জিরুডের ক্ষেত্রে এই কথাটা বেশ মানানসই। দুটি বিশ্বকাপের ব্যবধান ৪ বছরের। তবে নিজের সাথে নিজের ব্যবধানটা যেন আরো অনেক বেশি। এই চার বছরে জিরুডের বয়স বেড়েছে। তবে চিরন্তন নিয়ম মেনে খেলার ধারটা ঠিক কমেনি। বরং গত বিশ্বকাপের শূন্যতা মিলিয়ে গেছে এবারের কাতার বিশ্বকাপে তাঁর দুর্দান্ত সব গোলের মাধ্যমে।
স্ট্রাইকার হিসেবে ফ্রেঞ্চ কোচ দিদিয়ের দেশমের এবার প্রথম পছন্দ ছিলেন করিম বেনজেমা। কোচের পরিকল্পনায় বিশ্বকাপ শুরুর আগে জিরুড হয়তো ছিলেন, তবে তাঁকে ঘিরে পরিকল্পনাটা ঠিক এবার ছিল না। জিরুডও তাই বেঞ্চ গরম করাদের দলেই পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কী অদ্ভুত নিয়তি! বেনজেমা ইনজুরিতে পড়লেন। আর তাঁর জায়গায় জিরুড হয়ে গেলেন দেশমের অটোমেটিক চয়েস।
রাশিয়া বিশ্বকাপে দেশম প্রতিটা ম্যাচেই ভরসা রেখেছিলেন জিরুডের উপর। কিন্তু জিরুড সেবার কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ ছিলেন। তারপরও বিশ্বকাপ জয়ের কারণে আড়ালে চলে গিয়েছিল জিরুডের সেই ব্যর্থতা। কী মনে করে, দেশম এবারও জিরুডের উপর ভরসা রাখলেন।
আগেরবারের তিক্ত স্মৃতি। সাথে বয়সটাও পক্ষে কথা বলছে না। তারপরও জিরুড যেন ফিরে এলেন নব উদ্যমে। শুরুর ম্যাচে নেমেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করলেন দুই গোল। এরপর রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচেও পেলেন গোলের দেখা। পোলিশদের বিপক্ষে গোল করে থিয়েরি অঁরিকে (৫১) টপকে ফ্রান্সের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা বনে গেলেন ফ্রেঞ্চ এ স্ট্রাইকার।
ইংলিশদের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের হাইভোল্টেজ ম্যাচ। ফ্রান্স প্রথমে ইংলিশদের জালে বল জড়িয়ে এগিয়ে গেল বটে। তবে ম্যাচের পরের অর্ধে আবার পেনাল্টি থেকে গোল করে ইংলিশদের সমতায় আনেন হ্যারি কেইন। ম্যাচের এমন পরিস্থিতিতে মোমেন্টাম ঘুরে যায় ইংলিশদের দিকে ।
তবে বুড়ো হাড়ের ভেলকি বলে তো একটা কথা আছে। ফ্রান্সের এমন ক্রান্তি লগ্নে ত্রাতা রূপে হাজির হন অলিভার জিরুড। গ্রিজম্যানের বাড়ানো বল থেকে দারুণ এক ফিনিশিংয়ে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন তিনি। ম্যাচের পার্থক্য গড়ে যায় ঐ একটি গোলেই। আর এর মধ্য দিয়ে এ বারের বিশ্বকাপে নিজের চতুর্থ গোলের দেখা পান তিনি। এমবাপ্পের পর গোলসংখ্যায় যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
স্ট্রাইকার হওয়া স্বত্ত্বেও গত বিশ্বকাপে ফ্রান্সের একটি গোলেও সহায়তা করতে পারেননি জিরুড। সেই জিরুড এবার প্রথম ৫ ম্যাচেই করলেন ৪ গোল। একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করে ফ্রান্সকে নিয়ে গেলেন সেমিফাইনালে।
টানা দুই বিশ্বকাপ শিরোপার জন্য ফ্রান্সের প্রয়োজন আর দুটি জয়। গতবারে তেমন বলার মতো অবদান রাখতে না পারলেও এবার ঠিকই স্বপ্রতিভ হয়ে ফ্রান্সকে নিশ্চিতভাবেই শিরোপা জেতাতে চাইবেন জিরুড।
তবে সেই যাত্রায় কোচ দেশমকে একটা ধন্যবাদ তিনি দিতেই পারেন। কারণ এই জিরুডের প্রতি ভরসা রাখার জন্য তাঁকেও কম সমালোচনার শিকার হতে হয়নি। তবে দেশম নিজের সিদ্ধান্তে কিংবা দর্শনে ছিলেন অবিচল। আর তাঁর এই অনড় সিদ্ধান্তেই জিরুড নিজেকে ফিরে পেয়েছে। একই সাথে, রাশিয়ায় যেখানে তারা শেষ করেছিল, ঠিক যেন সেখান থেকেই দুর্দান্তভাবে চলার গতি পেয়েছে। আপাতত এই গতি থামবারও নয়।
সেমিফাইনালে ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ প্রথমবারের মতো সেমিতে ওঠা মরক্কো। ইতিহাস কিংবা দলের মান বিচারে,মরক্কো ফ্রান্সের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। তবে মরক্কো রুপকথায় এবার বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালদের মতো দলগুলোকে হারানোর কীর্তি আছে। তাই ৩২ দলের বিশ্বকাপের এ মহাযজ্ঞের এখন শেষ ৪ দলের কোনো দলকেই হেলায় দেখার সুযোগ নেই। ফ্রান্সও নিশ্চয় তেমন কিছু করবে না।
শেষ মুহূর্তে এসে এখন সব ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে কাগজে বড় দল, ছোট দল বলে কিছু নেই। নিজেদের দিনে এখন যে কোনো দল জিততে পারে। কারণ সে সব প্রতিকূলতা পেরিয়েই বিশ্বকাপের দৈর্ঘ্যটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শেষ ৪ এ। তবে ফ্রান্স নিশ্চিতভাবেই নিজেদের দিনে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। এমবাপ্পে, গ্রিজম্যান, জিরুডদের নিয়ে গড়া দলটা আরেকবার সেই শেষ দৌড়টা এখন দিতেই পারে।
আপাতত মঞ্চটা শক্তির বিচারে সহজসাধ্য। তবে তার ভিতরেও সীমাহীন কাঠিন্যতা, শত প্রতিকূলতা রয়েছে। ফ্রান্স কি সেই সব প্রতিকূলতা বেয়ে আবারো ঐ সোনালি ট্রফিটার কাছে যেতে পারবে? প্রশ্ন সরল, কিন্তু উত্তরটা জটিল। কারণ শুধু সম্ভাব্যতা ছাড়া এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তাই আপাতত আরো কিছু সময়ের অপেক্ষা। এ অপেক্ষা কিন্তু দীর্ঘ নয়, এই এলো বলে, আর মাত্র দিন সাতেক!