সুনীল সাগরের তীরে

খুব বেশি কায়-ধারী হয়ে না জন্মানো সুনীল, দৃপ্ত চিত্তে কী করে মধুর সুরের মুর্ছনার মতো হেড দেয়, আজও এর রহস্য ঠিক ভেদ হল না। এতটাই একাগ্রতা, এতটাই পারফেকশন! আজ, এই বৃষ্টিমুখর যুবভারতীতে বাঁ-পায়ের প্লেসমেন্টেও, সুনীলের হেডের মোহ থেকে বেরিয়ে আসা খুব দুরূহ ব্যাপার।

নস্টালজিক হয়ে, মনকে পিছিয়ে কয়েক যোজন দূর নিয়ে গেলে, পূর্বজরা বলেন লেখায় তার ছাপ পড়ে। সহমত হই। কারণ ভারতবর্ষের তূণীরে থাকা সুনীল ছেত্রী নামক এই বাণের, উত্থান থেকে গ্যালারিতে হাতজোড় করে দেশের ফুটবল দেখতে আসার অনুরোধের মতো বন্ধুর যাত্রাপথ – সবকিছুর সাক্ষী আমরা, এই দশকে বড় হওয়া এই ছেলেমেয়েরা।

যারা বব হাউটনের কোচিংয়ে সাফ কাপ জিততে দেখেছে বাইচুংয়ের নেতৃত্বে। যারা এন পি প্রদীপ, ক্লিফোর্ড মিরান্ডা, স্টিভেন ডায়াস, সুরকুমার সিং, মহেশ গাউলি, রবিন সিংয়ের মতো খেলোয়াড়দের দেখে দেখেই বড় হওয়ার পথে সমস্ত কাঁটা সরিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছে, আজ এই এত বছর পরেও তাদের রেখে যাওয়া ধ্বজের একমাত্র রক্ষ্ক, বাহক ও ধারকের নাম সুনীল ছেত্রী।

এই বছর ১২ জুন যার দেশের হয়ে ফুটবল ক্যারিয়ারের ১৭ তম বছর পূর্ণ হল। অথচ এখনও তার বিকল্প  নেই, এতগুলো বছর পেরিয়েও এই সদ্য এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে যার এখনই ৩ ম্যাচে ৪ গোল!

বহুদিন পর নীল জার্সির দামাল এগারোটা ছেলে দুর্দমনীয় পরাক্রম বজায় রেখে খেলছে। ওই ব্রেন্ডন, ওই লিস্টন, ওই সন্দেশ, ওই গুরপ্রীত, ওই সামাদ – ১৭ বছরের টানা যুদ্ধে লড়ে যাওয়া ওই ক্যাপ্টেন আজও মাঠে নামলে তার হৃদয়-অলিন্দ উজাড় করে দিতে চায় তাঁর দেশকে।

ওই পজিশনিং, ওই কন্ট্রোল, বক্সের ভিতর নিজেকে আনমার্ক করার এক অবিশ্বাস্য প্রবণতা, লব পাসে ফার্স্ট টাচ – সুনীলকে একটি শব্দে ব্যাখ্যা করার মতো শব্দ ভারতবর্ষের ভাণ্ডারে রিক্ত। আজ ভাবতে অবাক লাগে, এই সুনীল মোহনবাগানের জার্সি গায়ে পেনাল্টি মিস করেছিল। আবার এই সুনীল ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে কত সাবলীল গোলের নাম। এই সুনীল নিজেই এক সাগর, নিজেই এক দু:সাহসিক অভিযান।

সুনীল যখন হেডে গোল করছে বা করে বলা উচিত কারণ এটা তার এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে – তখন দেখতে হয় তার বডি পজিশন। মাথার সঙ্গে বুকের তফাতের ডিগ্রি, কোণ। বল যখন প্রায় মাথার কাছাকাছি অর্থাৎ স্কোরিং পজিশন, এমতাবস্থায়, বলের দিকে চোখ না সরিয়ে লাফিয়ে বডি পজিশনকে ৯০ ডিগ্রিতে কনভার্ট করা।

এটা বিশ্বে একজনই প্রায় নিখুঁত করেন, যার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কিন্তু তাহলে সুনীল কেন? কারণ, সুনীলের হাইট রোনালদোর তুলনায় কম, প্রায় মেসির সমানই বলা যায়। এই কম দৈর্ঘ্য নিয়ে একের পর এক গোল – বিধিলিখন বললে এই শিল্পকলার অপমান হয়।

বাইচুং ভুটিয়ার পর সুনীল। মাঝে রবিন সিং প্রদীপের ন্যায় আলো ছড়ালেও তা বেশি সময়ে কার্যকর হয়নি। সুনীলের পর? অনেক ট্যালেন্ট, অনেক নাম, অনেক আশার প্রদীপ। কিন্তু আর একটা সুনীল হবে কি? যে প্রখর সূর্যের তাপের কাছে, পাগল ঝড়ের চোখের কাছে, বৃষ্টিভেজা মাঠের কাছে নিজেকে নুইয়ে দিতে শেখেনি।

ভারতের হয়ে ৮৪ গোল করে যে নিজেকে ছাপিয়ে চলেছে উত্তরোত্তর। মাঠের প্রতিটা ঘাসে লিখে চলেছে গল্পগুলো। প্রতিটা ঘামের বিন্দুকে সাক্ষী রাখছে অদম্য জেদের, মানসিকতার। এ হেন যোদ্ধা আর কবে পাবে ভারত?

সুনীল সাগরের ওইপারে দাঁড়িয়ে ডুবতে থাকা দীপ্যমান সূর্য। সে ডুবে গেলে,‌ অন্ধকার?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link