সাহসী এক যোদ্ধা ক্রিকেটার

সবাই বিরাট, শচীন, গাভাস্কার, কপিল, ধোনির প্রতিভা নিয়ে জন্মান না। তাঁদের জন্য ৩৪ এর কাছাকাছি টেস্ট গড় নিয়েও যশপাল শর্মা রোল মডেল হতেই পারেন! অসম্ভব দুধ খেতে ভালোবাসা এবং সোজা কথার মানুষ যশপালের মৃত্যুর সাথে সাথেই কপিলের সেই বিশ্বজয়ী টিমে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ পড়লো! ভালো থাকবেন যশপাল! এরকমই থাকবেন! ডাকাবুকো দেশের পতাকা বুকের মধ‍্যে বয়ে বেড়ানো এক যোদ্ধা ক্রিকেটার!

কলকাতার বুকে যে অজস্র ক্রিকেট কোচিং সেন্টার গুলো গজিয়ে উঠেছে সেই রকমই একটা কোচিং সেন্টারের একটা গল্প: খুব স্বচ্ছল পরিবারের খুব আধুনিকা এবং শিক্ষিতা মা এসেছেন তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। প্রথম দিন তাঁর আবদার শুনে কোচিং সেন্টারের কোচ আর একটু হলেই ভূমিশয‍্যা নিতেন!

আবদারটা এই ছিলো যে তাঁর ছেলেকে ‘সাচিন’ (উচ্চারণটা এরকমই ছিল) বানিয়ে দিতে হবে। তাঁর ছেলেকে বোলার কেন নেটে এতো জোরে বল করছে বা তাঁর ছেলের বোলিং এর সময় উল্টো দিকের স্টাম্প গুলো কেন আরো সামনে সরিয়ে আনা হচ্ছে না! এই সব নানান অভিযোগে জেরবার কোচকে ভদ্রমহিলা অবশ‍্য এক সপ্তাহের মধ‍্যেই মুক্তি দেন ছেলেকে অন্য কোচিং সেন্টারে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে!

কেন জানি না সদ্যই যখন যশপাল শর্মার মৃত্যুর খবর পেলাম তখন খুব অপ্রাসঙ্গিক ভাবে এই গল্পটা মনে পড়ে গেলো! নাকি অপ্রাসঙ্গিক ভাবে নয়? প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে যশপালের খেলা আমি দেখি নি। কারণ যশপাল ভারতের হয়ে শেষ ম‍্যাচ খেলেন ১৯৮৫ তে। তখনো আমার গ্রামে টিভি আসেনি। তাই তাঁর সম্পর্কে আমার যতো টুকু জানা তা ‘খেলা’, ‘খেলার কাগজ’ বা ‘খেলার পাতার’ দৌলতে।

যশপাল যখন খেলা শুরু করেন তখন ক্রিকেট নামের খেলাটায় এতো অর্থের ঝনঝনানি ছিলো না। ছিল না ক্রিকেট নিয়ে এই পাগলামি, ছিল না এতো ক্রিকেট কোচিং সেন্টার, ছিল না ছেলেকে শচীন বা দাদা ( সৌরভ) বানিয়ে দেবার আবদার। গোটা দেশে লক্ষ লক্ষ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের ও আমদানি হয়নি তখন। ভারতীয় ক্রিকেটের মহাকাশে তখন দুটি বৃহৎ গ্রহের আবর্তন চলছে সুনীল গাভাস্কার এবং কপিল দেব নিখাঞ্জ। আশেপাশে রয়েছে অমরনাথ , বিশ্বনাথ বা ভেঙসরকারের মতো নামগুলো।

টেস্ট ক্রিকেটে ৩৩.৪৫ এবং ওয়ানডে তে ২৮.৪৮ গড় থাকা যশপাল খুব বড়ো ক্রিকেটার ছিলেন এমন কথা তাঁর মৃত্যুর দিনে দাঁড়িয়েও বলা যাচ্ছে না। টেস্টে সাকুল্যে দুটো সেঞ্চুরি এবং ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ৮৯ করা যশপালকে নিয়ে হয়তো আজ তাঁর মৃত্যুর দিনেও খুব বেশি আলোচনা হতো না যদি না তিনি ১৯৮৩ এর সেই অবিশ্বাস্য ভাবে বিশ্বকাপ জেতা কপিলের দলের সদস্য হতেন।

এবং এতো কিছু নেই এর পরেও যশপাল শর্মাকে ভারতীয় ক্রিকেট কে ভালোবাসা মানুষ মনে রাখবেন! কারণ যশপাল শর্মা তাঁর মধ‍্য মেধা নিয়েও ক্রিকেট টা খেলতেন হৃদয় দিয়ে। চিরিচ মিলোভান যখন ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন তখন বলেছিলেন, আমার দলে যদি এগারোটা বিশু থাকতো! বিশু মানে অবশ‍্যই বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য।

সেই চাওয়া টা যতোটা না বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যর ফুটবল প্রতিভার জন্য তার থেকেও বেশি মাঠে তাঁর কমিটমেন্টের জন্য। যশপাল শর্মাও ওই গোত্রের ক্রিকেটার ছিলেন। মাঠে দুশো ভাগ দিতেন সীমিত প্রতিভা নিয়েও। আসলে যশপাল বা মদনলাল এর মতো ক্রিকেটাররা একটু আলাদা ধরনেরই ছিলেন, ক্রিকেট এর ময়দানটাকে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র বলেই মনে করতেন।

সবাই বিরাট, শচীন, গাভাস্কার, কপিল, ধোনির প্রতিভা নিয়ে জন্মান না। তাঁদের জন্য ৩৪ এর কাছাকাছি টেস্ট গড় নিয়েও যশপাল শর্মা রোল মডেল হতেই পারেন! অসম্ভব দুধ খেতে ভালোবাসা এবং সোজা কথার মানুষ যশপালের মৃত্যুর সাথে সাথেই কপিলের সেই বিশ্বজয়ী টিমে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ পড়লো! ভালো থাকবেন যশপাল! এরকমই থাকবেন! ডাকাবুকো দেশের পতাকা বুকের মধ‍্যে বয়ে বেড়ানো এক যোদ্ধা ক্রিকেটার!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...