‘স্লেজিং’ – ক্রিকেটে মহলে এখন সবচেয়ে পরিচিত একটি শব্দ। এর পক্ষ-বিপক্ষে অনেক মত থাকলেও এখন স্লেজিংটা ক্রিকেটেরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্লেজিংয়ের ইতিহাসও কিন্তু নতুন নয়। ক্রিকেটের শুরু থেকেই স্লেজিংয়ের অস্তিত্ব আছে। স্লেজিংকে যদি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলের এই শিল্পের সেরা শিল্পী হলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান পেসার মার্ভ হিউজ।
স্লেজিং করার মূল কারণ হলো বিপরীত দলকে মানসিক ভাবে ভেঙে ফেলা। যাতে দলকে সহজেই একটি জয় এনে দেওয়া যায়। স্লেজিং হল কথার লড়াই। কখনো এই কথার লড়াইয়ে লাভ হয়, কখনো ক্ষতিও হয়। এবার এমন কিছু স্লেজিংয়ের স্মৃতিচারণা করবো যেটা করতে গিয়ে পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছেন।
- আমির সোহেল ও ভেঙ্কটেশ প্রসাদ
আমির সোহেল এবং ভেঙ্কেটেশ প্রসাদের স্লেজিংয়ের ঘটনায় দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীতার ছাপ পড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। স্লেজিংয়ের এই ঘটনা ঘটেছিলো ক্রিকেটে বিশ্ব মঞ্চে। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জায়গা পাওয়ার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিলো পাকিস্তান এবং ভারত। প্রথমে ব্যাটিং করে ২৮৭ রানের বিশাল সংগ্রহ তৈরি করে ভারত। রান তাড়া করতে নেমে পাকিস্তানের দুই ওপেনার আমির সোহেল এবং সাঈদ আনোয়ার যেভাবে শুরু করেছিলো তাতে এই লক্ষ্যটা বেশ মামুলি হয়ে উঠেছিলো পাকিস্তানের জন্য।
ঘটনাটি ঘটেছিলো তখনই যখন ভেঙ্কটেশ প্রসাদের বোলিংয়ে চার মেরেছিলেন আমির সোহেল। চার মারার আমির সোহেল ব্যাট উঁচু করে ভেঙ্কটেশ প্রসাদকে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন ওই একই দিক দিয়ে আবারো চার মারবেন তিনি। আমির সোহেল পরের বলে একই ভাবে চার মারার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। এইভাবে স্লেজিংয়ের শিকার হয়ে নীরবে বোলিংয়ে মার্কে ফিরে যান ভেঙ্কটেশ প্রসাদ। পরবর্তী বলে এমন ভাবে করেন তাতে বল আমির সোহেলে ব্যাটে নয় স্ট্যাম্পে গিয়ে আঘাত করেছিলো।
এই ঘটনা ওই ম্যাচের সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। পাকিস্তান ভারতের কাছে ৩৯ রানে হেরে যায়। আমির সোহেল আউট হবার পর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে পাকিস্তান। আর এর ফলেই বিশ্ব মঞ্চে দ্বিতীয় বারের দেখাতেও ভারতের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় পাকিস্তান।
- শচীন টেন্ডুলকার ও আব্দুল কাদির
ভারত-পাকিস্তান এই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে আরেকটি ‘রগরগে ঘটনার জন্ম দেন দুই কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার এবং আব্দুল কাদির। এই ঘটনা ঘটেছিলো যখন ১৬ বছর বয়সী শচীন টেন্ডুলকার ক্যারিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে যান। এই সফরে প্রস্তুতি ম্যাচে ওয়াকার ইউনুসের বলে নাক ফেটে যায়।
দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতীয় দল পাকিস্তানের বিপক্ষে চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য তাড়া করতে নামে ভারত। ব্যাটিংয়ে নেমে শচীন টেন্ডুলকার মুশতাক আহমেদকে তুলোধনা করতে শুরু করে। মুশতাক আহমেদকে কয়েকটি ছক্কা হাঁকান। এটি দেখে আব্দুল কাদির শচীন টেন্ডুলকারকে বলেন, ‘বাচ্চাদের কেন মারছো! পারলে আমাকে মারো!’
আব্দুল কাদির যখন বোলিংয়ে আসেন তাঁর বলে বেশ কিছু দুর্দান্ত কিছু স্ট্রোক খেলেন তিনি। আব্দুল কাদিরের এক ওভারে চার ছক্কা হাঁকান তিনি। পরবর্তীতে শচীন হাফ সেঞ্চুরি করতে পারলেও ভারতীয় দল ম্যাচ হেরে যায়।
- মার্ভ হিউজ ও জাভেদ মিয়াঁদাদ
ক্রিকেটের স্লেজিং তালিকা কখনোই সম্পূর্ণ হবে না, যখন সেই তালিকায় অস্ট্রেলিয়ান পেসার মার্ভ হিউজের নাম না থাকবে। যখন মার্ভ হিউজ স্লেজিং করা শুরু করেন তখন তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা স্লেজিং করা ক্রিকেটার হিসেবে নিয়োজিত হন। তিনি তাঁর দক্ষতা দেখিয়েছিলেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াঁদাদের সাথে।
এটা বিশ্বাস করতেই হবে যে, জাভেদ মিয়াদাদ নিজেই খুব বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা তাকে স্লেজিং না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের এই কিংবদন্তি স্লেজিং করে বসেন অস্ট্রেলিয়ান পেসার মার্ক হিউজকে। ব্যাটিংয়ে মার্ক হিউজকে মোকাবিলা করার সময়ে পাকিস্তানি কিংবদন্তি জাভেদ মিয়াদাদ বলেন, ‘মার্ভ, তুমি একটা বিরাট-মোটা বাস কন্ডাক্টর!’
জাভেদ মিয়াদাদের কাছে এই কথা শোনার পর তাঁকে আউট করার জন্য আরো তেঁতে উঠেন হিউজ। বোলিং হয়ে ওঠে আরো ভয়ানক। কয়েক বল পর মার্ভ জাভেদ মিয়াদাদকে আউট করতে সক্ষম হন। আউট হয়ে জাভেদ মিয়াদাদ প্যাভিলিয়নে ফেরার সময় মার্ক হিউজ জাভেদ মিয়াদাদকে বলেন, ‘টিকেট প্লিজ।’
- হরভজন সিং ও শোয়েব আকতার
এই দুই আক্রমণাত্মক ক্রিকেটারের মধ্যে স্লেজিংয়ের ঘটনা ঘটেছিলো ২০১০ সালের এশিয়া কাপে। প্রথমে ব্যাটিং করে পাকিস্তান ২৬৮ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় পাকিস্তান। এই রান তাড়া করতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে ভারত। এই অবস্থায় ম্যাচটি ঝুলে পড়তে থাকে পাকিস্তানের পক্ষে। ঠিক এই সময়ে রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস এবং ইন্ডিয়ান টার্বুনেটরের মধ্যে স্লেজিংয়ের ঘটনা ঘটে।
শোয়েব আকতার বোলিংয়ে এসে সুরেশ রায়নার কাছে প্রথম বলে ছক্কা খান। এরপরে হরভজন ব্যাটিংয়ে গিয়ে একই রকম বাউন্সার পাওয়ার আশা করেছিলেন। আর সাথে পুল শট খেলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যাট-বলের সঠিক সংযোগ না ঘটায় বলটি মিস করেন হরভজন সিং। এই ঘটনা দেখে শোয়েব আকতার হরভজন সিংয়ের দিকে তেড়ে যান এবং তাদের মধ্যে কিছু বাক্য বিনিময় হয়।
শেষ ওভারে বোলিংয়ে আসেন মোহাম্মদ আমির। বোলিংয়ে এসেই এই গতি তারকা তুলে নেন সুরেশ রায়নাকে। পরবর্তীতে শেষ দুই বলে দরকার ছিলো তিন রান। আমিরকে মিড অফের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচটি জিতে নেয় ভারত। ছক্কা হাঁকিয়ে হরভজন শুধু শোয়েব আকতারের মুখই বন্ধ করেননি, পাকিস্তানকে এশিয়া কাপের নক আউট পর্ব থেকেও বিদায় করে দেন।
- ব্রায়ান লারা ও দানিশ কানেরিয়া
এটা বিশ্বাস করা হয় ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা ব্যাটিংয়ের সময় প্রতিপক্ষের সাথে প্রচুর কথা বলতেন। এই সময়ে পাকিস্তানি লেগ স্পিনার দানিশ কানেরিয়া ব্যঙ্গাত্মক ভাবে পরিহাস করা শুরু করেছিলেন। এই সময়ে ব্রায়ান লারা এটা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তাঁর মনসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য কানেরিয়া তাকে স্লেজিং করছিলো।
এই ঘটনার শুরু হয় তখন যখন কানেরিয়ার প্রথম বলে বাউন্ডারি মারা চেষ্টা করেছিলেন ব্রায়ান লারা। এমনকি দ্বিতীয় বলে গুগলি করেছিলেন কানেরিয়া। এই সময়ে দূর্দান্ত ভাবে মোকাবিলা করেন ব্রায়ান লারা। বল মোকাবিলা করতে দেখে কানেরিয়া ব্রায়ান লারাকে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে বলেন, ‘ভালো খেলেছো, ব্রায়ান।’ এর প্রতিউত্তরে লারা বলেন, ‘ধন্যবাদ, স্যার।’ কিন্তু কানেরিয়া ধারণা করতে পারেননি পরের তিন বলে তাঁর উপর দিয়ে কি রকম ঝড় যেতে পারে। খোঁচাটা সহজ ভাবে নেননি ক্রিকেটের বরপুত্র।
পরবর্তী তিন বলে তিনটি ছক্কা হাঁকান ব্রায়ান লারা। কানেরিয়ার ঐ এক ওভারে ২৬ রান নেন তিনি। মুলতানে অনুষ্ঠিত এই টেস্ট ড্র হয়েছিলো, কিন্তু ব্রায়ান লারা ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে করেছিলেন ২১৬ রান।
- বীরেন্দ্র শেবাগ ও শোয়েব আকতার
এই স্লেজিংয়ের ঘটনা ঘটেছিলো মুলতান টেস্টে। যেখানে ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দ্র শেবাগ ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান। শেবাগ এবং শচীন মিলে গড়ে তোলেন ৩৩৬ রানের জুটি। এই জুটির কল্যাণে মুলতানে সিরিজের প্রথম টেস্ট জিতে সিরিজে এগিয়ে যায় ভারত।
এই ম্যাচে স্লেজিংয়ের ঘটনা ঘটেছিলো তখন যখন শেবাগ বেশ ভালোভাবে রান করছিলো। এই সময়ে বল করতে এসে দূর্দান্ত বাউন্সার দিতে থাকেন শোয়েব আকতার। তিনি বাউন্সার বল দিয়ে শেবাগকে বার বার হুক শট খেলতে বলেন।
শোয়েব আকতার বার বার হুক শট খেলতে বলার কারণে শেবাগ পাকিস্তানি ফিল্ডারদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সে কি বোলিং করতে এসেছে নাকি ভিক্ষা করতে এসেছে!’
শেবাগের রসবোধ এতটাই ছিল যে পাকিস্তানের ফিল্ডাররাও হেসে দেন। ভারতীয় ইনিংসের শেষে শোয়েব আকতার ৩২ ওভার বোলিং করে ১১৯ রান দিয়ে উইকেট শূণ্য ছিলেন।