ছবিতে দু’জন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। আমরা যারা সাফল্য আর ব্যর্থতা নামের দুটো চরমবিন্দুর মাঝখানে বেঁচে বর্তে থাকি, যারা মনে করি এ পৃথিবীতে মানুষ দুই প্রকার, সফল এবং ব্যর্থ, যারা ভাবি কালের নিয়মে সফল মানুষকে এ দুনিয়া মনে রাখে, ব্যর্থ মানুষ হারিয়ে যান অতলে – তাদের জন্য এই ছবিটা একটা পাজলবুক।
ছবিতে যে দ্বিতীয় মানুষটিকে আপনারা দেখছেন, টাকমাথা, কাঁচাপাকা দাড়ি, একবিংশ শতাব্দীতে সেই মানুষটি আক্ষরিক অর্থেই ট্রফি সংখ্যার বা জয়ের নিরীখে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সফল কোচ। যিনি প্রথম আবির্ভাব থেকেই বিশ্বকে দেখিয়েছেন কীভাবে সফল হতে হয়, কীভাবে ভিনি-ভিডি-ভিসির মতো এই জীবনের ময়দানে মাঠে নেমেই একটা স্থির সাফল্য নামক বিন্দুর দিকে নিজের সবটুকু দিয়ে ছুটতে হয়, কীভাবে, কতটা লড়াই করতে হয় সফল হবার জন্য- এই মানুষটির নাম পেপ গার্দিওলা।
যাঁর হাতে তৈরী হয়েছে বিশ্বফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ টিকিটাকা ফুটবল জমানা।
এবার আসি দ্বিতীয় মানুষটির কথায়। বয়সের ভারে একটু ন্যুব্জ, একটু ম্লান হওয়া হাসি। বিশ্বফুটবলের ইতিহাস লেখা হলে এই মানুষটি থাকবেন চরম ব্যর্থ একজন কোচ হিসেবে। মানুষ তাঁকে নাম দিয়েছে ‘এল লোকো’ বা ক্ষ্যাপাটে লোক। পোষাকি নাম মার্সেলো বিয়েলসা।
আর্জেন্টিনার যে শহর থেকে লিওনেল মেসি উঠে এসেছেন সেই রোজারিও শহরের মানুষ এই বিয়েলসা৷ জীবনের কিছুটা সায়াহ্নেই দাঁড়িয়ে তিনি। অথচ এই চূড়ান্ত ব্যর্থ লোকটার কাছেই একদিন খাতা কলম নিয়ে শিক্ষালাভ করতেন পাশের চরম সফল মানুষটি। এই সফল মানুষটি আবার সর্বত্র পাশের ব্যর্থ মানুষটিকে শ্রেষ্ঠ কোচ বলে দাবী করে আসেন। বিষয়টা কেমন অদ্ভুত না?
এই ব্যর্থ লোকটি একটা দুরন্ত দল নিয়ে বিশ্বকাপের গ্রুপ স্টেজ থেকে বেড়িয়ে গেল, একটার পর একটা ক্লাবে কোচিং করাতে গেল, ছোটো ক্লাব, সেভাবে প্রচার নেই, ট্রফি পাওয়াও সম্ভব না, অথচ প্রত্যেকটা দল একবাক্যে মেনে নিল তাঁদের খেলা আমুল পাল্টে গেছে এই ব্যর্থ লোকটার হাত ধরে।
লোকটা দিনে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৫-১৬ ঘন্টাই পাগলের মতো পড়ে আছেন ঐ মাঠটাকে নিয়ে, গোল বলটাকে নিয়ে। ২০০৭-২০১১ সালে চিলি ফুটবল দলের খেলা দেখে স্বয়ং জোহান ক্রুয়েফ বলেছিলেন এই দলটা শ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলছে কিন্তু তবু, সাফল্য বলতে এই সমাজ যাকে বোঝে অর্থাৎ শিরোপা, সেটা তো আর নেই!
বিশ্বের বাকি সফল কোচেরা যখন তাঁকে গুরু মানছেন তখন মিডিয়াও লোকটাকে নিয়ে ধন্দে। এক প্রেস কনফারেন্সে তাঁকে প্রশ্ন করা হয় যে আপনি এত ট্রফি জিতেছেন? কথাটা নিজেই থামিয়ে তিনি বলেন, ‘মিথ্যে বলবেন না, আমি ট্রফি জিতিনি৷ সেটা সকলেই জানে।’
অথচ যে কথাটা এই ব্যর্থ লোকটি বলেন নি তা হলে- আমার ট্রফি জেতা দিয়ে সত্যিই কিছু যায় আসে না কারণ আমি জানি আমি সফল!
হ্যাঁ, তিনি সফল। তিনি সফল কারণ তিনি সারাজীবন নিজের পারফেকশনকে ছুঁতে দৌড়েছেন, সাফল্যকে না। নিজের ফুটবল গবেষণার যে ফর্মুলা তাকে পরিশীলিত করার জন্য দৌড়েছেন। তিনি জানেন যে তিনি ব্যর্থ হবেন কিন্তু তবু নিজের লক্ষ্য থেকে সরছেন না। তিনি জানেন যে তাঁকে দল বহিস্কার করে দিতে পারে তবু তিনি অনড়।
আজ যারা প্রিমিয়ার লিগ দেখেন তাঁরা নিশ্চই দেখতে পাচ্ছেন যে দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে উঠে আসা একটা দল লিডস ইউনাইটেড কীভাবে লিগের তাবড় দলগুলোকে মাটি ধরিয়ে দিচ্ছে, সকলে বিয়েলসাকে নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু একথা বিয়েলসাও জানেন যে তিনি খেতাব জিততে পারবেন না, মানুষ ভুলে যাবে কে কত ভালো খেলেছিল- যেভাবে মানুষ ভুলে গেছে তাঁর তিরিশ বছরের লড়াই-টা, এতগুলো ছেলেকে ফুটবলার তৈরী করার ইতিহাসটা, বিশ্বফুটবলকে হাইপ্রেসিং এর সাথে পরিচয় করানোর দিনগুলো।
আসলে শ্রুতায়ুদার কথা ধরেই বলা যায়- ‘এল লোকো আসলে এক চরম ব্যর্থ লোকের নিজের পারফেকশনকে ছুঁতে চাওয়ার নাম…’
জীবনে আমরা সফলতা মানে বুঝি খেতাব, সম্মান কিন্তু দিনের শেষ গোধুলির আলো মেখে বিয়েলসা দাঁড়ান, তিনি আমাদের সকলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, সফলতা আসলে নিজের লক্ষ্যকে ছুঁতে পারার নাম, নিজের সাধনার শেষ বিন্দুতে পৌছোনোর নাম, সফলতা আসলে দিনের শেষে নিজেকে আয়নার সামনে স্বচ্ছভাবে দাঁড় করানোর নাম- আর ক্রমাগত ব্যর্থতাই আমাদের সেই সফলতার পথে এগিয়ে দেয়, আমাদের শিক্ষিত করে প্রতিদিন।
এই ছবিটা সফলতা আর ব্যর্থতাকে একটা ক্যালাইডোস্কোপে ভরে উল্টে পাল্টে দিচ্ছে, এই ছবিটা আসলে একটা জীবনের ছবি- যেখানে পেপ গার্দিওলা আপনাকে শেখাবেন কীভাবে সফলতা অর্জন করতে হয় আর মার্সেলো বিয়েলসা আপনাকে শেখাবেন সফলতা আসলে কী!