বর্তমানে ইউরোপীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় নামগুলো নিয়ে আলোচনায় বসলে ম্যানচেস্টার সিটি ও রিয়াল মাদ্রিদের নাম আসতে বাধ্য। সত্য বলতে আলোচনার সবচেয়ে বড় হট টপিকই হবে এই দুই ক্লাব। ম্যানচেস্টার সিটি কিংবা রিয়াল মাদ্রিদ– দুই ক্লাবই নিজেদের ঘরোয়া লিগের গন্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক ক্লাব ফুটবলে নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষনা দিয়ে আসছে সগর্বে। ক্লাব ফুটবলের জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় উভয় ক্লাবকেই প্রতিপক্ষ দলগুলো সবসময়ই আলাদাভাবে সমীহ করে থাকে।
মহাশক্তিধর দুই ক্লাব যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে মাঠে নামে, তখন তা ফুটবলবোদ্ধা থেকে শুরু সমর্থকদের নজর কাড়বে তাই স্বাভাবিক বটে। চলতি মৌসুমের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে এবার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ এবং ম্যানচেস্টার সিটি।
হেড টু হেডে দুই দলই রয়েছে সমতায়। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে সর্বমোট ৬ বারের দেখায় রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছিলো ২ বার এবং ম্যানসিটি’র জয় ২ বার। ড্র’তে নিষ্পত্তি হয়েছিল বাকি ২টি ম্যাচ। সর্বশেষ ২০১৯-২০ মৌসুমে দেখা হয়েছিল এই দুই দলের। নক আউট পর্বের সে লড়াইয়ে দুই লেগেই রিয়াল মাদ্রিদ’কে হারিয়েছিল ইংলিশ ক্লাবটি।
২০২০-২১ মৌসুমের পর টানা দ্বিতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। রাউন্ড অব সিক্সটিনে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই এর বিপক্ষে অবিস্মরণীয় একটি কামব্যাকের পর কোয়ার্টার ফাইনালে ইংলিশ ক্লাব চেলসি’কে হারিয়ে সেমিতে নিজেদের জায়গা করে নেয় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা।
অন্যদিকে গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রানার আপ হয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি। এবারও তারা দাপট দেখিয়েই সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে৷ রাউন্ড অব সিক্সটিনে স্পোর্টিং লিসবনকে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার পর কোয়ার্টার ফাইনালে তারা হারিয়েছিল স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ’কে।
সাম্প্রতিক ফর্মের বিবেচনায় দুইদলই রয়েছে দারুন ছন্দে। ঘরোয়া লীগে পয়েন্ট টেবিলে দুই দলের অবস্থান শীর্ষে। সর্বশেষ দশটি লিগ ম্যাচে অপরাজিত পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা। অন্যদিকে মৌসুমের শুরু থেকেই দাপট দেখানো রিয়াল মাদ্রিদও সর্বশেষ চারটি লিগ ম্যাচেই ধরে রেখেছে জয়ের ধারা। এছাড়াও সর্বশেষ ছয়টি অ্যাওয়ে ম্যাচে হারেনি লস ব্ল্যাঙ্কোসরা।
তবে ফুটবল নব্বই মিনিটের খেলা, খেলতে হয় মাঠের সবুজ ঘাসে। পুরোনো তথ্য কিংবা অতিত রেকর্ড দিয়ে ম্যাচের ফলাফল আনা যায় না। নব্বই মিনিট ধরে ভাল খেলা কিংবা গোল বেশি দেয়া দলটাই শেষ পর্যন্ত জিতবে। ম্যাচের আগমুহূর্তে তাই দুই দলই সতর্কতার সাথে সাজিয়ে নিচ্ছে রণকৌশল।
◾ স্কোয়াডঃ
গ্যাব্রিয়েল জেসুস, রাহিম স্টার্লিং, রিয়াদ মাহরেজ এর মত খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে তৈরি ম্যানসিটি’র আক্রমন রয়েছে দারুন ফর্মে। প্রতিম্যাচে গোল করছেন, করাচ্ছেন সবাই, আর তাই সিটি’র আক্রমনভাগ এখন নিঃসন্দেহে সমীহ জাগানিয়া। ইংলিশ ক্লাবটির মিডফিল্ডে সময়ের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনা তো আছেনই, সাথে তরুন ফিল ফোডেন, রদ্রিগো রয়েছে দলটির মধ্যমাঠে। পর্তুগিজ মিডফিল্ডার বার্নান্দো সিলভা, গুন্দোয়ানদের ক্রিয়েটিভ প্লে-মেকিং যেকোনো দলের জন্য চিন্তার কারন। এছাড়াও ডিফেন্স সামলানোর দায়িত্বে আছে লাপোর্তে, স্টোনস।
অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় আস্থার নাম থিবো কোর্তায়া। পুরো মৌসুম জুড়ে দুর্ধর্ষ সব সেভ করে মুগ্ধ করা এই গোলরক্ষকের দিকে এই ম্যাচেও তাকিয়ে থাকবে রিয়াল। এছাড়াও মিলিটাও-আলাবা ডিফেন্সিভ জুটি ভাঙ্গাও প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিডফিল্ড রিয়ালের সবচেয়ে বড় গর্বের জায়গা। ক্যাসেমিরো,মদ্রিচ, ক্রুসদের সাথে রয়েছে তরুন কামাভিঙ্গা এবং ফেদে ভালভার্দে। আক্রমনে রিয়াল মাদ্রিদের গত তিন মৌসুম ধরেই নায়ক বেনজেমা, আর এবারের মৌসুমে তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স চুরমার করে যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান সাম্বা বয় ভিনি জুনিয়র।
◾ সম্ভাব্য ট্যাকটিক্সঃ
আগের ম্যাচগুলোর মতই ৪-৩-৩ ফরমেশনে দল সাজাতে পারেন পেপ গার্দিওলা। চারজনের ডিফেন্সে দুইজন সেন্টারব্যাক এবং দুইজন ফুলব্যাক; এর উপরে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে রদ্রিগো, তার দুই পাশে দুই মিডফিল্ডার। সবার উপরে স্ট্রাইকার এবং দুই পাশে দুই উইঙ্গার। এমন ছকেই ম্যানচেস্টার সিটি’র মাঠে নামার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। মাঠে স্বভাবসুলভ পজেশনিং খেলা খেলার চেষ্টা করবে দলটি। পাশাপাশি দুই উইঙ্গারের গতি ব্যবহার করেও মাদ্রিদের ডিফেন্সের ভাল পরীক্ষা নিবে তারা। ডিফেন্সে অভিজ্ঞতা আর তারুন্যের মিশ্রন হতে পারে।
সফরকারী রিয়াল মাদ্রিদও তাদের প্রিয় ৪-৩-৩ ফরমেশনে মাঠে নামবে। হোল্ডিং মিডফিল্ডারের পজিশনে ক্যাসেমিরো’র খেলা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এছাড়া মিডফিল্ডে বাকি দুজন কে হবে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। অভিজ্ঞ মদ্রিচ, ক্রুস কিংবা ইন ফর্ম ফেদেরিকো ভালভার্দেকে মিডফিল্ডে দেখা যেতে পারে। তবে বল পায়ে রেখে ধীর গতির খেলা নয় বরং রিয়ালের লক্ষ্য থাকবে হাই প্রেসিং করে কাউন্টার এটাকে খেলা। ভিনি জুনিয়রের গতি এক্ষেত্রে রিয়ালকে অবশ্যই বাড়তি সুবিধা দিবে।
◾ইনজুরি আপডেটঃ
ম্যানচেস্টার সিটি’র ডিফেন্সে প্রথম পছন্দ রুবেন দিয়াস ইনজুরির কারনে অনেকদিনই মাঠের বাইরে থাকলেও গত ম্যাচে দলে ফিরেছিলেন। তবে ইনজুরির কারনে ম্যানচেস্টার সিটি’র নিয়মিত একাদশের সদস্য কাইল ওয়াকারের খেলা নিয়ে শঙ্কা রয়েছ। এছাড়াও কার্ড নিষেধাজ্ঞার কারনে রাইটব্যাক জোয়াও ক্যান্সেলো এর সার্ভিস মিস করবে দলটি।
অন্যদিকে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের শিবিরে ইনজুরি বড় দুশ্চিন্তার কারন। ক্যাসেমিরো, ডেভিড আলাবা এবং ফারলান মেন্দি-র খেলা নিয়ে এখনো সংশয় কাটেনি।
◾সম্ভাব্য শুরুর লাইনআপঃ
ম্যানচেস্টার সিটিঃ এডারসন, কাইল ওয়াকার/ নাথান আকা, রুবেন দিয়াস, আয়মেরিক লাপোর্তে, জিনচেঙ্কো, রদ্রিগো, কেভিন ডি ব্রুইনা, বার্নান্দো সিলভা, রিয়াদ মাহরেজ, রাহিম স্টার্লিং, ফিল ফোডেন/গ্যাব্রিয়েল জেসুস।
রিয়াল মাদ্রিদঃ থিবো কোর্তোয়া, দানি কারভাহাল, এডার মিলিটাও, ডেভিড আলাবা/নাচো ফার্নান্দেজ, ফারলান মেন্দি, ক্যাসেমিরো, লুকা মদ্রিচ, টনি ক্রুস, ভিনি জুনিয়র, রদ্রিগো/ফেদে ভালভার্দে, করিম বেনজেমা।
চলতি মৌসুমের এমন হাই ভোল্টেজ ম্যাচ মঞ্চায়িত করতে প্রস্তুত মঞ্চ। প্রথম লেগের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ম্যানচেস্টারের ইতিহাদ স্টেডিয়ামে। ২৬ এপ্রিল রাত ১টায় দুই দেশের দুই সেরা ক্লাব একে অপরের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। শুধু জয় নয়, এই লড়াই তাই মর্যাদা’র লড়াই বটে।
পেপ গার্দিওলা’র জগৎবিখ্যাত টিকিটাকা নাকি আনচেলত্তি’র কাউন্টার এটাক; কার ট্যাকটিক্স বাজিমাত করবে ম্যাচে? ইতিহাদে শেষ হাসি হাসবে কে? দুই ফুটবল পরাশক্তির এমন মহাযুদ্ধ দেখতে উদগ্রীব হয়ে আছে কোটি কোটি চোখ।