আমি যখন জীবনে প্রথম টেস্ট খেলতে নামি, শুনেছি তখন আমারই সমবয়সী এক বাঙালিকে নিয়ে নাকি জোর তুফান উঠেছিল টিম সিলেকশন মিটিংয়ে। সঞ্জয় মাঞ্জরেকার চোট পাওয়ায় আমাকে লর্ডসে নামান জামার কলার তোলা, রিস্টি অধিনায়ক। সঙ্গে ঐ ছেলেটিকেও। সে ১৩১ করেছিল। চারিদিকে বাহবা, ফুলের বুকে। অনেকেই জানে আবার জানে না, সেদিন আমিও ৯৫ করেছিলাম। কেউ সেভাবে মনে রাখেনা। দরকার নেই।
আমি যখন ভারতের হয়ে একের পর এক অবিস্মরণীয় টেস্ট ইনিংস খেলেছি, তখনও দেখেছি আমারই পিঠাপিঠি ইনিংস খেলে লাইমলাইট নিয়ে চলে গেছে অনেকে। জোহানেসবার্গের ১৪৮ যেমন। আমি লাইমলাইট একবারই ভাল ভাবে পেয়েছি, অ্যাডিলেডে ২৩৩ করার পর। কিন্তু সেভাবে আমি লাইমলাইট চাইনি কোনওদিন। অতটা দরকার নেই।
আমি যখন ভারতের অধিনায়ক হই, তখন আমার সাথে ডেবিউ করা সেই বন্ধুটির টিমে থাকা দায় হয়ে উঠেছে। আমি চেষ্টা করেছিলাম কোচের সাথে তার ঝামেলা মিটমাট করাতে, কিন্তু আমি অতটা অ্যাগ্রেসিভ নই বলে পারিনি। কিছু সময় পর আমার অধিনায়কত্বও চলে যায়। তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ আমি শুধু ব্রিটানিয়া ব্যাট আর ২২ গজটা চিনতাম। আমি ভারতবর্ষের হয়ে ক্রিকেট খেলা বলতে ঐটুকুই বুঝতাম।
আমি ৩১৭৫৮ টা বল খেলেছি শুধু গোটা টেস্ট ক্যারিয়ারে। ব্যাটে বল ঠোকার শব্দটা ছিল আমার কাছে রবিশঙ্করের সেতারের মত। এমন একটা ঘোরে চলে যেতাম, যেখানে ঢালাই করা পাঁচিল তৈরী হয়ে যায়। যতই পাথর ছোঁড়া হোক, কিছুই হবে না। আমি শুধু ব্যাট করতাম। আর খেলা থেকে ফিরে হোটেলের ঘরে ঢুকে চুপ করে বই পড়তাম।
কিছু কিছু সময়, যখন সেটডিয়ামে কেউ থাকত না আমি চলে যেতাম। যেখানে উইকেট পোঁতা হয়, তার পাশে চুপ করে বসে কনসেনট্রেট করতাম। গোটা স্টেডিয়াম এর আওয়াজ নিজের কানে নিতাম। কারণ, পরদিন ঐ শব্দব্রহ্মের মধ্যেই আমাকে পাঁজর লক্ষ্য করে আসা বলগুলো ব্লক করতে হতো।
আমি যখন ক্যারিয়ার শেষ করি, তখন কিছুদিন আইপিএলে খেলেছিলাম। আমিও ছয় মারতাম। মারতে জানতাম। জীবনের একমাত্র টিটোয়েন্টিতে সমিধ পটেলকে পরপর তিন বলে তিনটি ছয় মেরেছিলাম। তবু মনে হত, এটা ঠিক আমার জন্য নয়। তাই আমি অন্য দিকে মন দিই।
নতুন যারা উঠে আসছে, তাদেরকে টেস্ট ক্রিকেটটা ঠিক কিভাবে খেলতে হয় সেটা বোঝানোর চাকরি নিই। ছেলেগুলো কথা শোনে। আমিও শেখাই। ওরা পারফর্ম করে, আমারই মত বুকে ধেয়ে আসা বল খেলে, আমি ব্যাঙ্গালুরুর বাড়িতে বসে চোখের জল মুছি। আমার কাছে ওদের খেলা প্রতিটা ডেলিভারিই গুরুদক্ষিণা।
আমি রাহুল শরদ দ্রাবিড়। লোকে আগে আমাকে দেওয়াল বলত। এখন আর আমি দেওয়াল নেই। আস্ত একটা ছাদ হয়ে গেছি। আমার ছাদের তলায় বসে শুভমান গিলরা প্র্যাকটিস করে। আবার আসবে ওরা, আমি জানি।