দূরত্ব ভালোবাসি!

২০০৫ সাল, রিয়াল মাদ্রিদ বনাম সেভিয়া।

১৮ মিনিটে ফ্রি কিকে ওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছেন ডেভিড বেকহাম ও জিনেদিন জিদান। সেখান থেকে রামোস সরাসরি শট নিলেন পোস্টে। ক্যাসিয়াসের সাধ্য ছিল না সে শট থামানোর। সেই এক গোল রামোসকে এনে দেয় রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি। এমনকি জিদান পর্যন্ত তাকে আনার জন্য বলেন পেরেজকে।

সার্জিও রামোস ছিলেন পেরেজের প্রথম স্প্যানিশ গ্যালাক্টিকো সাইনিং। সাইনিংয়ের ১৫ বছর পরেও রিয়াল মাদ্রিদকে আপন করে নিয়ে খেলে যাচ্ছেন রামোস। কে বলবে রামোস রিয়ালের হোমগ্রোন খেলোয়াড় নন, বরং রামোস রিয়ালের থাকতে থাকতে তাদেরই একজন হয়ে গিয়েছেন। হয়েছেন ইতিহাসের সাক্ষী, ২০১৪ লা ডেসিমার ৯২.৪৮, থ্রি-পিট জয়, ডাবল জয়, সব জয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ রামোস।

কিন্তু সেই রামোস এখন নাকি চলে যেতে চাইছেন!

রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের কপালে এখন চিন্তার বলিরেখা। যতটা না রিয়ালের খেলা নিয়ে তার থেকে বেশি নিজেদের অধিনায়কের দল ছাড়া নিয়ে। সার্জিও রামোসের সাথে চুক্তির আর মাত্র ৬ মাস বাকি; এর মধ্যেও কী না সমঝতায় আসতে পারেনি দুইপক্ষ। নতুন বছরের শুরু থেকেই নতুন কোনো দলের সাথে প্রি-কন্ট্রাক্ট করে রাখতে লিগ্যালি কোনো বাধা নেই রামোসের।

এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষই মুখ ফুটে কিছু বলছে না, কিন্তু মিডিয়া তো আর গুজব রটাতে সময় নেয় না। গুজবে গুজবে সরগরম মিডিয়া এখন রামোস আর প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের পিছু পিছু ঘুরছে।

সার্জিও রামোসের সাথে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সম্পর্ক স্বভাবতই ভালো। দলকে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দেওয়া অধিনায়কের সাথে যেচে পরে ঝগড়া করতে যাওয়ার মতন বোকাও রিয়ালের পোড় খাওয়া প্রেসিডেন্ট নন। কিন্তু যেখানে টাকার কথা আসে, সেখানে সম্পর্কে মনমালিন্য তো হয়ই। রামোস আর পেরেজের ব্যাপারটাও ঠিক একই রকম।

সার্জিও রামোসের বয়স এখন ৩৪। এই মার্চে পা দিবেন ৩৫-এ। তাই বলে ভাববেন না হারিয়ে গিয়েছেন। ব্রং পোড় খাওয়া ডিফেন্ডার আর লিডারদের মতন দিনকেদিন বাড়িয়ে চলছেন তার স্কিল। দিনকে দিন তাকে দেখে হতে হচ্ছে মুগ্ধ। রামোস যেন চাইলেই পারেন। তাই ৩৫ বছর বয়সে এসে এটাই সম্ভবত তার জীবনের শেষ বড় কন্ট্রাক্ট। তাই রামোস চাচ্ছেন তার সর্বোচ্চটা বুঝে পেতে।

রিয়ালের ওয়েজবিলে সেকেন্ড হায়েস্ট অবস্থানে রয়েছেন রামোস। তার উপরে একমাত্র হ্যাজার্ড। যদিও চাইলেই বছরে ১৫ মিলিয়ন ইউরোর থেকে অনেক বেশি কামাতে পারেন রামোস, তবুও রিয়াল মাদ্রিদের প্রতি ভালোবাসা থেকে এটাতেই সন্তুষ্ট তিনি। তাই জীবনের শেষ বড় কন্ট্রাক্টে তাই ২ বছর একই টাকায় খেলতে চাইছেন রামোস। পেরেজ বেঁকে বসেছেন এখানেই। অন্তত স্প্যানিশ মিডিয়ার দাবি তাই।

পেরেজ চাচ্ছেন সমান পরিমান (১৫ মিলিয়ন) বেতন নিলে ১ বছরের জন্য কন্ট্রাক্ট বাড়াতে, আর যদি ২ বছর থাকতেই চায়, তবে তার জন্য তাকে ১০% বেতন (১৩ মিলিয়ন) কমাতে হবে। এখানেই দুজনের মূলত বাঁধছে। মিডিয়ার মতে রামোস আর পেরেজের দ্বন্দ্বটা এই টাকা পয়সা নিয়েই। রামোসের যে ফর্ম আর লিডারশিপ, তাতে করে অন্য কোনো ক্লাবে ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন ইউরো কামাতে পারবেন অনায়াসে। মৌসুম শেষে ফ্রি এজেন্ট হয়ে যাওয়া রামোস তাই চাইলেই দেখতে পারেন অন্য দল।

এই আগুনে আবার ঘি ঢেলেছেন সার্জিও রামোসের ভাই ও এজেন্ট রেনে রামোস। ‘রামোসের চুক্তিকে এই পর্যায়ে আনা রিয়ালের জন্য অপমানসূচক’ একটি ফ্যান টুইট রিটুইট করে রেনে রামোস বিতর্ককে উসকে দিয়েছেন। এতে যেন রামোস আর পেরেজের পুরনো দ্বন্দ্বগুলো আবার মনে করিয়ে দিল। রামোস আর পেরেজের মধ্যে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব কিন্তু এই প্রথম নয়।

পুরোনো দ্বন্ধগুলো ফিরে দেখা যাক।

  • ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অফার (২০১৫)

২০১৫ এর সামার ট্রান্সফার উইন্ডোতেই প্রথম তাদের দ্বন্দ্ব নিয়ে সামনে আসে মিডিয়া। সদ্য অধিনায়কত্ব পেয়েছেন রামোস; ১ মাসও হয়নি দল ছেড়েছেন ইকার ক্যাসিয়াস। ২৭ বছর রিয়াল মাদ্রিদে কাটানোর পর রিয়ালের প্রিয় ‘সন্ত’ ছেড়ে যান নাড়ি ছেড়ে। যোগ দেন পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোতে। এ নিয়ে পেরেজের সাথে মাদ্রিদিস্তাদের দ্বন্দ্ব অজানা নয়।

নিজেদের ক্লাব লেজেন্ডকে এভাবে কোনো সংবর্ধনা ছাড়া চলে যেতে দেখে বেশ মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিল সমর্থকেরা। ইয়াক্রের অনুপস্থিতিতে অধিনায়কের দায়িত্ব পান এতদিনের সহ-অধিনায়ক রামোস।

কিন্তু এ সুযোগটাই হাতিয়ে নিয়েছিলেন তাই ভাই ও এজেন্ট রেনে রামোস। ক্যাসিয়াস চলে যাওয়ার পর রিয়ালের অধিনায়কত্ব চলে আসে সার্জিও রামোসের হাতে। আর সেসময়ই আসে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে অফার। সেসময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবস্থাও তেমন বলার মতন ছিল না, লুই ভ্যান হালের হাত ধরে রিবিল্ডিংয়ের চেষ্টা চালাচ্ছিল তারা। অন্যদিকে ইকারকে ছেড়ে দিয়ে রিয়াল চাইছিল তাদের গোলবারের নিয়ে স্প্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল তারকাকে ভেরাতে। তাই রিয়ালের নজর ছিল তাদের গোলরক্ষক ডেভিড ডে হেয়ার দিকে।

যদিও রামোসকে বিক্রি করবার কোনো প্ল্যান ছিল না, বরং ছিল কেইলর নাভাসকে দিয়ে ডে হেয়াকে দলে ভেরানোর চেষ্টা। সেসময় রামোসের সামনে এই অফার ছিল নিজের ক্যারিয়াকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। সুযোগ ছিল প্রিমিয়ার লিগ খেলার। সে সুযোগটা নিয়েছিলেন রেনে রামোস। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সাথে কয়েকদফায় বসে রামোসের বেতন বেড়িয়ে নেন প্রায় ৫০ শতাংশ।

ইকার ক্যাসিয়াসের সাথে সাথে রিয়ালের আরেকজন খেলোয়াড় দল ছাড়বেন, এটা সহ্য করা রিয়াল সমর্থকদের জন্য অসম্ভবই ছিল। আর সেটা রেনে জানতেন খুব ভালোমতো। রামোসকে এতো সহজে দল থেকে ছাড়বেন না। তাই ৬ বছরের কন্ট্রাক্টে বাড়িয়ে নেন নিজের ভাইয়ের বেতন।

  • আয়াক্স বনাম রিয়াল (২০১৯)

পরপর তিনবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী দল। হোক তাদের মূল খেলোয়াড় আর দলে নেই, তবুও কী এমন রেজাল্ট মেনে নেওয়া সম্ভব? তাও আবার সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে এসে। রিয়াল মাদ্রিদের মাটিতে এসে রিয়ালকে হারিয়ে দেওয়ার মতন দুঃসাধ্য কাজ করে দেখিয়েছিল আয়াক্সের এক ঝাঁক তরুণ তারকারা।

নিজেরদের মাটিতে এক হালি গোল হজম করার পর স্বভাবতই রেগে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। তাই ম্যাচ শেষে নেমে আসেন ড্রেসিং রুমে, নেমে এসেই শাসাতে শুরু করেন খেলোয়াড়দের। এমনও নাকি বলেন, ‘তাদের খেলায় ডেডিকেশনের অভাব স্পষ্ট।’

নিজের সতীর্থদের এমন কথা শুনতে দেখে থাকতে পারেননি রামোস। বরং নিজের সতীর্থদের বাচাতে নিজেই চলে আসেন ঢাল হয়ে। রোনালদো চলে যাওয়ার পর রোনালদোর পরিবর্তে কোনো খেলোয়াড় যোগ হয়নি স্কোয়াডে, বরং কিনে আনা হয়েছে ব্রাজিলিয়ান স্টারকিড। এ নিয়ে বেশ বড়রকম কথাকাটাকাটি হয় পেরেজ আর রামোসের মধ্যে।

রামোস বলেন, ‘আপনার করা পুরো প্ল্যানিংয়েই ভুল ছিল। সেটার ফলাফল হচ্ছে এটা।’

এরপর নাকি পেরেজ রামোসকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন। যার পরিবর্তে রামোস বলেন, ‘পয়সা বাড়িয়ে দাও, নইলে আমি চললাম।’

রামোস-পেরেজের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু মূলত এখান থেকেই। যদিও ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড কেসের দাগ মিলিয়ে গিয়েছিল ৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ দিয়ে, কিন্তু এই ক্ষতর দাগ ছিল অটুট।

  • চাইনিজ ক্লাবের অফার (২০১৯)

আয়াক্সের ঘটনার মাসখানেক পরের ঘটনা। রামোসের তখনও দুই বছরের কন্ট্রাক্ট বাকি, তার সাথে রয়েছে ৮০০ মিলিয়ন রিলিজ ক্লজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও রিয়াল অধিনায়ক মিটিংয়ে বসেন প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আর জেনারেল ম্যানেজার হোসে অ্যাঞ্জেলো সানচেজের সাথে। মিটিংয়ের মূল বিষয়াদি ছিল রামোসের জন্য চাইনিজ একটি ক্লাব থেকে ভালো একটি অফার আছে। কিন্তু চাইনিজ ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী তার যদি ৩০ মিলিয়নের বেশি দিয়ে কোনো খেলোয়াড় কিনে তবে তার সম্পরিমান অর্থ ট্যাক্স দিতে হবে। যে কারণে রামোস মিটিংয়ে বসেছিলেন তাকে ফ্রিতে দল থেকে রিলিজ করে দেওয়ার জন্য।

অবিশ্বাস্য এই অফার কানেই তুলেননি পেরেজ। একে তো দলের অধিনায়ক, তার উপর ফ্রিতে ছেড়ে দেওয়া। হতে পারে কয়েক মাস আগে ড্রেসিং রুমে মন্মালিন্য হয়েছে, কিন্তু তাই বলে দলের অধিনায়ককে তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না। আগের মৌসুমে দলের সেরা খেলোয়াড় দল ছেড়েছে, আর এই মৌসুমে অধিনায়ক? এ কখনও সম্ভব?

মুখের উপর রামোসকে না করে দেন পেরেজ। ৮০০ মিলিয়ন রিলিজ ক্লজের খেলোয়াড়কে এভাবে ছেড়ে দেওয়া সম্ভবই না। ‘দলের অধিনায়ককে ফ্রিতে ছেড়ে দেওয়া খুবই খারাপ একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।’

যদিও পরে রামোস নিজে থেকেই সরে আসেন সেই অফার থেকে। কয়েকদিন পরে রামোস নিজে থেকেই বলেন, ‘আমি রিয়াল মাদ্রিদে রিটায়ার করতে চাই। রিয়ালের লিজেন্ড হিসেবেই আমি নিজেকে শেষ করতে চাই।’

রিয়ালের প্রথম গ্যালাক্টিকোস, দ্বিতীয় গ্যালাক্টিকোস নিজ চোখে দেখা। ভাঙ্গা-গড়া সবই তার সামনে দিয়ে হয়ে যাওয়া। সার্জিও রামোস রিয়ালের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওভাবে চিন্তা করলে রিয়াল কিংবা পেরেজের ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু নামটা যে বিজনেস টাইকুন পেরেজ। কোভিড পরিস্তিতিতে এতকিছুর মাঝেও রিয়ালকে লাভের মুখ দেখিয়েছেন, এতকিছুর পরেও রিয়াল ছাটাই করেনি কোনো স্টাফ, ক্লাবকে ঠিক করে তৈরি করছে নতুন স্টেডিয়াম।

প্রেসিডেন্ট পেরেজের আমলে সবই হয়েছে, যেমন গড়া হয়েছে গ্যালাক্টিকোস, তেমনই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে রাউল, রোনালদোদেরও। রামোসের ভাগ্যে কী আছে, তা এখন সময়ই বলতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link