বিরল এক প্যাকেজ

কর্তারা দাবি করেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) নাকি বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর। সেটা না হলেও বিপিএল সত্যিই ইউনিক। কারণ, এখানে ক্রিকেটের চেয়ে বিতর্ক থাকে বেশি। এবারের বিপিএলও এর ব্যতিক্রম নয়। ফিক্সিংয়ের কানাঘুষা, অধিনায়ক পাল্টানো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, আম্পায়ারিং, ডিআরএস কিংবা বল টেম্পারিং – কি নেই এখানে।

এর মধ্যে ক্রিকেটটাই যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে, ধন্যবাদ সাকিব আল হাসানকে। তিনিই তো এই আসরের প্রাণ ফেরাতে প্রায় একা এক হাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, প্রতিটি ম্যাচে। হ্যাঁ, সত্যি প্রতিটি ম্যাচেই।

৯ ম্যাচে ৬ জয়ে ১২ পয়েন্টস নিয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) এবারে আসরে এখন পর্যন্ত শীর্ষে ফরচুন বরিশাল। সবশেষ পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিতেই জয় পেয়েছে দলটি। আর বরিশালের এই জয়রথের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান নি:সন্দেহে সাকিব আল হাসানের। ব্যাটিং, বোলিং ও বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে দলের জয়ে নিজের সেরাটাই দিয়ে যাচ্ছেন এই বিশ্বসেরা তারকা।

ব্যাট হাতে ১৯ বলে ৪ ছক্কা ও ২ চারে ৩৮ রানের ঝড়ো ইনিংস এবং বল হাতে ২৩ রানে ২টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট! সিলেট সানরাইজার্সের বিপক্ষে ১২ রানের জয়ে অলরাউন্ড নৈপুণ্যে দেখিয়ে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছেন সাকিব। এ নিয়ে টানা চার ম্যাচেই তিনি জিতেছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। আসলে আগের ম্যাচে সাকিবের পারফরম্যান্স কি সেটা নতুন করে বলতে হয় না – চারটা ম্যাচেরই যিনি সেরা তারকা তাঁকে ঘিরে নানারকম পরিসংখ্যানের কচকচানি তো বাহুল্যতা।

টুর্নামেন্ট যতোই সামনে গড়াচ্ছে ব্যাটে-বলে সাকিব যেন হয়ে উঠছেন আরো আগ্রাসী। বল হাতে অবশ্য পারফরম করছিলেন নিয়মিতই, তবে ব্যাট হাতে টি-টোয়েন্টিতে লম্বা সময় ধরেই ছিলেন সাদামাটা। এবারের আসরের প্রথম চার ম্যাচে ব্যাট হাতে করেছিলেন মোটে ১১.৫ গড়ে ৪৬ রান!

বল হাতে অবশ্য ছিলেন দুর্দান্ত। প্রথম চার ম্যাচে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। সেই সাকিবই শেষ চার ম্যাচের দুই ইনিংসে করেছেন ফিফটি। বাকি দুই ইনিংসেও করেছেন তাণ্ডবময় ব্যাটিং। শেষ ৪ ম্যাচে ৪৪.৫ গড়ে ২ ফিফটিতে করেছেন ১৭৮ রান! স্ট্রাইক রেটও ১৫০+! বল হাতে শিকার করেছেন ৭ উইকেট।

শুধু ব্যাটিং কিংবা বোলিংই নয় অধিনায়ক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন বিচক্ষণতাও। অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের আগ্রাসী মাইন্ডসেট সুফল বয়ে এনেছে দলের জন্যেও। তবে মুজিব উর রহমান, মুনিম শাহরিয়ারদের কাছ থেকেও পেয়েছেন সেরা সাপোর্ট। সব মিলিয়ে বরিশালের সাফল্যের পেছনের মূল কারিগরটা সাকিবই।

এইতো ম্যাচ কয়েক আগেও সমালোচনা হচ্ছিলো সাকিবের ব্যাটিং নিয়ে। টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের ব্যাটে আগের সেই ধারটা নেই, ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও ব্যাট হাতে তিনি সাদামাটা। প্রায় ৩০ মাস, ৪৫ ইনিংস পর চলতি বিপিএলে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচে দেখা পেয়েছেন টি-টোয়েন্টিতে ফিফটির। স্রেফ এই পরিসংখ্যানটি বলে দেয় গেলো কয়েক বছরে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ব্যাট হাতে সাকিবের ব্যর্থতা।

তবে, নামটা যে সাকিব আল হাসান। এর আগেও ব্যর্থতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন বার বার। শেষ চার ম্যাচে সাকিবের ব্যাটিং মনে করিয়েছে এই ফরম্যাটে ব্যাট হাতে তিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি। চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে মারকাটারি ব্যাটিংয়ে মাঠে এ যেনো এক অন্য সাকিব! বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও দলের হয়ে সেরাটা দিচ্ছেন।

এইতো কিছুসময় আগেও টি-টোয়েন্টিতে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসতেন হরহামেশাই। ব্যাট হাতে সাদামাটা হলেও বল হাতে সেরাটা দিয়ে পুষিয়ে দিতেন ঠিকই। তবে টি-টোয়েন্টির চেনা সাকিবকে মিস করছিলেন ভক্ত-সমর্থকরাও।

যে সাকিব ব্যাট হাতে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন, তিনিই এবারের বিপিএলের এখন পর্যন্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার। টুর্নামেন্ট সেরা হবার দৌড়েও এগিয়ে আছেন সবার থেকেই। দীর্ঘসময় পর টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট হাতে সাকিবের এই রাজকীয় প্রত্যাবর্তন একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে যে – তিনি ববাবরের মত এবারও নিজেকে ভেঙেচুড়ে গড়ছেন।

সাকিবের মত ব্যাটিং টি-টোয়েন্টিতে অনেকেই করেন। তাঁর মত বোলারও আছেন বিস্তর। আর এমন অধিনায়ক তো পাওয়াই যায়। তবে, এই সবকিছু মিলে পূর্ণাঙ্গ একটা প্যাকেজ খুঁজে পাওয়াটা মুশকিল। ক্রিকেটের ইতিহাসেই সাকিব তাই বিরল। তিনি বিরল এক প্যাকেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link