একটা সময় হন্যে হয়ে নিজেকে ক্রিকেট মাঠে প্রতিষ্ঠিত হতে ঘুরে বেড়িয়েছেন রসি ভ্যান ডার ডুসেন। জন্মভূমি দক্ষিণ আফ্রিকার পাশপাশি ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, কানাডা এমনকি ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জেও ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। খুঁজে বেড়িয়েছেন নিজেকে প্রমাণের সুযোগ।
দিগ্বিদিক ঘুরে সেই জন্মভূমিই দিলো তাঁকে ঠাই, সেখানেই পেলেন তিনি সুযোগ আর বনে গেলেন সময়ের সেরা। কেন তাঁকে সময়ের সেরা বলছি এমন প্রশ্ন এসেছে মনে? আচ্ছা বলছি তবে।
রসি ভ্যান ডার ডুসেন ডান-হাতি মিডেল অর্ডার ব্যাটার। টপ অর্ডারেও ব্যাট করতে যার বিন্দুমাত্র অপ্রতুলতা নেই। নিজের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতেই দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পাশপাশি আরো ভিন্ন দেশের ঘরোয়া লিগে অংশ নিতে থাকেন তিনি। মনে ভেতর কিছু করে দেখানোর স্পৃহা ছিলো তাঁর। তিনি বিশ্ববাসীকে বলতে চাইছিলেন ‘দেখো আমার ব্যাটিং দেখো’। প্রথম সুযোগটা পেয়েছিলেন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রোটিয়াদের হয়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর বোর্ডে ১৬০ রান তুলতে ভ্যান ডার ডুসেন করেন ৪৪ বলে ৫৬। সেই থেকেই উত্থান এবং আজকে গড়ের পাহাড় চূড়ায় অবস্থান। অবশ্য এর আগে তাঁকে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। ২০১৭/১৮ মৌসুমে লম্বা ফরম্যাটে ছিলেন মৌসুমের সেরা রান সংগ্রাহক।
আর টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পাওয়ার আগে কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট জয়ের অভিজ্ঞতাও বাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন কন্ডিশনে খেলার অভিজ্ঞতা থাকায় জাতীয় দলের আগে ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফরে পাঠানো হয় ভ্যান ডার ডুসেনকে। এরপর আসে বহুল প্রতিক্ষিত জাতীয় দলের ডাক।
জিম্বাবুয়ের সাথে দুই ম্যাচে ৬৯ রান তাঁকে ওয়ানডে দলের অভিষেক হতে বিরত রাখেনি। ঠিকই পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের শুরুতেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলার সুযোগ পেয়ে যান ভ্যান ডার ডুসেন। রীতিমত অবাক করে দেন সবাইকে।
তাঁর ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছিলো তিনি যেন বহুকাল ধরে খেলছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। পাকিস্তানের দারুণ বোলিং আক্রমণের সামনে অভিষেক ম্যাচেই অল্পের জন্যে হাতছাড়া হয় প্রথম শতক। সাত রান আগেই হাসান আলীর বলে কাঁটা পড়েন শোয়েব মালিকের হাতে। এর পরের ম্যাচেই থাকেন অপ্রতিরোধ্য। করেন ৮০।
নিজের জায়গাটা ওয়ানডে দলে পাকাপোক্ত করে ফেলেন ভ্যান ডার ডুসেন। অবশ্য পাকা হওয়া তো ছিল অবধারিত। ভিন্ন অঞ্চলের ক্রিকেট জ্ঞান, নিজের সক্ষমতা আর দৃঢ়তা সাথে ধৈর্য্য এসব কিছু মিলিয়ে প্রোটিয়াদের ভরসা হয়ে উঠতে খুব বেশি কালক্ষেপণ করেননি রসি ভ্যান ডার ডুসেন। তাইতো বছরের শেষভাগে টেস্ট ক্যাপটাও পেয়ে যান তিনি। সেখানেও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখার প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। কিন্তু সাফল্যের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ওয়ানডে ক্রিকেট।
বর্তমানে ভ্যান ডার ডুসেনের ওয়ানডে গড় দেখে চক্ষু চড়কগাছ। অভাবনীয়, অভূতপূর্ব। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের সর্বকালের সব মিডল অর্ডার ব্যাটারদের পরিসংখ্যান ঘেটে দেখলেও তাঁর সমপরিমাণ গড়ের কাছাকাছি কাওকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৩২ ম্যাচে ২৬ ইনিংস ব্যাট করে ভ্যান ডার ডুসেনের গড় ৭৪.৫২। মাত্র দুইটি শতকে দেখা পেয়েছেন তিনি। নয়টি ইনিংসে ছিলেন অপরাজিত। সত্যিই প্রশংসনীয়! এমনকি বর্তমান বিশ্বে ন্যুনতম ২০টি ইনিংস খেলা কোন ব্যাটারের গড় থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতেই অবস্থান করছেন ভ্যান ডার ডুসেন।
এমন কীর্তিতেও অতি উচ্ছ্বসিত নন ভ্যান ডার ডুসেন। ভারতের বিপক্ষে দারুণ একটি সিরিজ পার করবার পর তিনি বলেন, ‘আমি এটার (গড়) মনোযোগ দেই না। আপনারা হয়ত দেন কেননা আপনারা টিভিতে দেখেন। কিন্তু আমি মনে করি আমরা প্রতিটা ম্যাচই শুরু করি শূন্য থেকে এবং পরিস্থিতি বুঝে দলের প্রয়োজনে খেলার চেষ্টা করি।’
নিজের ব্যাটিং রেকর্ড নিয়ে খুব একটা চিন্তা করেন না বলেই হয়ত এমন দূর্দান্ত এক সময় পার করছেন প্রোটিয়া এই ব্যাটার। কি সাবলীলভাবে রেকর্ড গড়েও ভ্রুক্ষেপহীন দিনাতিপাত। তবে নিজের ক্যারিয়ারের শেষে নতুন কোন মাইলফলক রেখে তৈরি করে রেখে যেতে পারবেন কিনা রসি ভ্যান ডার ডুসেন তা হয়ত বলে দেবে সময়। কিন্তু একজন সাধারণ ক্রিকেট ভক্ত হয়ত চাইবে সদা হাস্যজ্বল থাকুক ভ্যান ডার ডুসেনের ব্যাট, চলতে থাকুক রানে ফোয়ারা।