ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন চেলসির মত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হোক, প্রথম লেগে ৩-১ গোলে জিতে রীতিমতো আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। দ্বিতীয় লেগ ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যু-তে, তাই মাঠে নামার আগে সহজেই সেমিফাইনালের স্বপ্ন দেখেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। তবে মাঠে নামার পরেই বদলে যেতে শুরু করে দৃশ্যপট।
রিয়াল মাদ্রিদ দুই গোলে এগিয়ে থাকায় দ্বিতীয় লেগে নিরামিষ খেলা হবে ভেবে অনেকে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন, তবে ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারবেন কি মিস করে ফেলেছেন। না, চেলসি কোন অতিমানবীয় কামব্যাকের গল্প লিখে ফেলেনি তবে রিয়ালের ঘরে মাঠে রিয়াল ভক্তদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রতি মিনিটেই উত্তাপ ছড়িয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ এবং চেলসি ম্যাচ।
কি ছিল না এই ম্যাচে? অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক তো ছিলই, পাশাপাশি ছিল বল দখলের শক্ত লড়াই, ছিল ট্যাকেল আর ফাউল। প্রতি মূহুর্ত রোমাঞ্চ ছড়িয়ে অবশেষে শেষ হয়েছিল ম্যাচটি। গোলবন্যার এই ম্যাচেও রেফারি-কে ৩৭ বার ফাউলের বাঁশি বাজাতে হয়েছিল। সাতবার বুক পকেট থেকে বের করতে হয়েছিল হলুদ কার্ড-টি। সবমিলিয়ে রোমাঞ্চের সব রসদ ছিল চেলসি-রিয়াল দ্বৈরথে।
দল এগিয়ে থাকায় সহজ ম্যাচ হবে বলে হয়তো ভেবেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ম্যানজেম্যান্ট। তবে চেলসি কোচ টমাস টুখেলের দুর্দান্ত ট্যাকটিক্সে ম্যাচের শুরু থেকেই কোনাঢাসা হয়ে পড়ে স্বাগতিক দল। ম্যাসন মাউন্ট, টিমো ভার্নার’রা বারবার হানা দিয়েছিল মাদ্রিদের ডিফেন্সে। আক্রমণের ধারাবাহিকতায় ম্যাচের মাত্র পনের মিনিটের মাথায় দল-কে এগিয়ে দেন তরুণ ইংলিশ তারকা ম্যাসন মাউন্ট।
এরপরেও আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখে ইংলিশ ক্লাব-টি। তবে বিরতির আগ পর্যন্ত আর কোন গোল না পাওয়ায় ১-০ স্কোরলাইন নিয়েই ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয়। চেলসি’র আক্রমণ আর দলের ছন্নছাড়া ভাব দেখে অনেক রিয়াল ভক্ত হয়তো শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল ম্যাচের ফলাফল নিয়ে।
বিরতি থেকে ফেরার একটু পরেই কর্নার পায় চেলসি, আর সেট-পিস থেকে দুর্দান্ত এক হেডারে চেলসি ডিফেন্ডার রুডিগার ম্যাচের স্কোরলাইন ২-০ করে তোলেন। এগ্রিগেটে তখন দুই দল সমানে সমানে, স্কোরলাইন ৩-৩। রিয়াল সমর্থকদের শঙ্কা তখন প্রায় সত্যি হয়ে গিয়েছিল। অবিশ্বাস্য এক কামব্যাকের স্বপ্ন তখন হাত ছোঁয়া দূরত্বে ছিল চেলসির।
ম্যাচের যখন ৬৩ মিনিট তখন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা মার্কো অলনসো’র শট রিয়ালের জাল খুঁজে নেয়, তবে দ্য ব্লুজ দের উদযাপন থেমে যায় একটু পরেই। অলনসো’র হাতে বল বল লাগায় হ্যান্ডবলের সিদ্ধান্ত জানায় ভিএআর( ভিডিও অ্যাসিসট্যান্ট রেফারি), বাতিল হয়ে যায় অলনসো’র করা গোলটি।
সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও মিনিট দশেক পরে ৭৪ মিনিটের সময় আর রক্ষা হয়নি রিয়ালের। সব শঙ্কা আর দুশ্চিন্তা-কে সত্যি করে ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় চেলসি। দুই লেগ মিলে তখন ম্যাচের স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৪-৩। টিমো ভার্নারের এই গোলের পর অনেকেই রিয়াল মাদ্রিদের বাদ পড়া ধরেই রেখেছিলেন। তবে ২০০৩-০৪ মৌসুমের পর থেকে কখনোই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়েনি রিয়াল মাদ্রিদ। এবারও তাই আশা হারায়নি তাঁরা।
ম্যাচে ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পরেও দারুণ ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় আনচেলত্তির শিষ্যরা। শুরুটা মদ্রিচ-রদ্রিগোর হাত ধরে। ক্রোয়াট এই মিডফিল্ডারের শৈল্পিক এক থ্রু পাসে দারুন ফিনিশিং করে দুই লেগ মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদকে সমতায় ফেরান রদ্রিগো। দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৪ স্কোরলাইন হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
পুরো ম্যাচে কিছুটা নিষ্প্রভ থাকা বেনজেমা এবার বেরিয়ে আসেন খোলস ছেড়ে। আগের ম্যাচের হিরো, করিম বেনজেমা অতিরিক্ত সময়ে ভিনিসিয়ুসের কাছ থেকে আসা ক্রসে মাথা ছুঁয়ে গোল করে বসেন। ম্যাচের তখন ৯৬ মিনিট। এরপর আর কোন দল গোল করতে না পারায় ম্যাচের ফলাফল দাঁড়ায় ৩-২। তবে দ্বিতীয় লেগে হেরেও দুই লেগ মিলিয়ে (৫-৪) এগিয়ে থাকায় সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় রিয়াল মাদ্রিদ।
দুই লেগ মিলিয়ে গোল হয়েছে নয়টি, যার মধ্যে চারটি করেছেন করিম বেনজেমা। দারুন ফর্মে থাকা ফ্রান্সের এই স্ট্রাইকার এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে করেছেন ইতোমধ্যে ১২ গোল। অধিনায়কের মতই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ-কে রক্ষা করেছেন তিনি। পাশাপাশি এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ছয়টি অ্যাসিস্ট করে অ্যাসিস্টদাতা-দের তালিকায় সবার উপরে উঠে আসেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার ভিনি জুনিয়র।
মাঠে রিয়াল মাদ্রিদের এগারোজন সবাই পারফর্ম করেছে, এদের মধ্যেও লুকা মদ্রিচ এবং ফেদেরিকো ভালভার্দের কথা আলাদা করে বলতে হয়। এই বয়সে এসেও মদ্রিচ ৫০/৫০ বলগুলো দখলের জন্য হৃদয় নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। এমনকি আজকের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন লুকা মদ্রিচ। অন্যদিকে তরুন ফেদে ভালভার্দে ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই গতি-তে দৌড়ানো দেখে নিশ্চয়ই ভেবেছেন দুইটি ফুসফুস নিয়ে খেলতে নেমেছিল কিনা।
খুব কাছে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে চেলসি। প্রথম লেগের ব্যবধান কমিয়ে নিজেরা এগিয়ে যেতে পারলেও শেষ পর্যন্ত বাদ পড়তে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে। রাউন্ড অব সিক্সটিনে ফরাসি লিগ ওয়ান টেবিল টপার পিএসজি-কে হারানোর পর, এবার রিয়াল টপকে গেলো গতবারের চ্যাম্পিয়স লিগ জয়ী চেলসি বাঁধাও।
দুই লেগেই হয়তো মাঠের পারফরম্যান্সে সেরা দল চেলসি, গোলে সুযোগ রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে বেশি তৈরিও করেছিল চেলসি কিন্তু গোল পাওয়া হয়নি। ফুটবল খেলা-টা গোলের খেলা, দূর্দান্ত খেলেও তাই হেরে যেতে হয়েছে দ্য ব্লুজ’দের। আর তাই মাউন্ট, হাভার্টজ, জর্জিনহো’দের চোখেমুখে শেষ বাঁশি বেজে উঠার পর ভেসে উঠেছিল হতাশা অথবা যন্ত্রনা।
প্রতিপক্ষ কোচের বুদ্ধির কাছে অনেকটাই প্রিয় দল-কে নাস্তানাবুদ হতে দেখেছিল সমর্থকেরা। দেখেছিল এমন একটি কর্নার থেকে গোল হজম করতে, যেটি আদতে কর্নার ছিল ই না। দলের মূল ডিফেন্ডার এডার মিলিটাও কার্ড নিষেধাজ্ঞায় মাঠের বাইরে, ব্যাকআপ ডিফেন্ডার নাচো ফার্নান্দেজকে ইনজরির কারণে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। বাধ্য হয়ে রাইটব্যাক দানি কারভাহাল-কে খেলতে হয়েছে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে।
সব মিলিয়ে ভেঙে পড়ার অবস্থায় ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। হয়তো ভেঙে পড়তো, কিন্তু যে দলে লুকা মদ্রিচ আর ফেদেরিকো ভালভার্দের মত মিডফিল্ড খুঁটি রয়েছে সে দল সহজে ভাঙবে কেন? রিয়ালও ভেঙ্গে পড়েনি, লড়াই করেছে ম্যাচের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালের টিকেট নিয়েই মাঠ ছেড়েছে লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। পাশাপাশি পূর্নতা পেয়েছে গত মৌসুমে হারের প্রতিশোধ নেয়া।
সর্বশেষ বারো মৌসুমের আটটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই সেমিফাইনালে উঠা রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এমন মঞ্চ নতুন নয়। ক্লাব ইতিহাসে ৩১ তম বারের সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ ম্যানচেস্টার সিটি কিংবা অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ। দেখার বিষয় চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সামনের দিকে আর কতদূর এগুতে পারে দুর্দমনীয় হয়ে ওঠা রিয়াল মাদ্রিদ।