অ্যাশেজ ২০১৯। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে তখন ব্যাটিংয়ে টিম অস্ট্রেলিয়া। ৮০ রানে অপরাজিত থাকা স্টিভেন স্মিথ ছিলেন ব্যাটিং প্রান্তে। ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষিক্ত জোফরা আর্চার ৭৭তম ওভারের ২য় বলটা ছুঁড়ে দিলেন গোলার মত। আর সেই বলটি গিয়ে আঘাত করে স্মিথের ঘাড়ে। মাঠের সবারই মনে হয়তো পড়ে গিয়েছিল ফিলিপ হিউজের কথা।
অবশ্য সেবার শঙ্কা দূর করে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং চালিয়ে গিয়েছিলেন অজি তারকা। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে আর পারেননি, বাধ্য হয়েই অস্ট্রেলিয়াকে ব্যবহার করতে হয়েছিল কনকাশন ক্রিকেটার। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম কনকাশন হিসেবে স্মিথের জায়গায় সেদিন মাঠে নেমেছিলেন মার্নাস লাবুশেন।
ব্যাট হাতে নেমেই সেই আর্চারের বলে আঘাত পেয়েছেন লাবুশেনও। কিন্তু এরপর উঠে দাঁড়িয়েছেন, ভরসা রেখেছেন নিজের টেকনিক আর আত্মবিশ্বাসের উপর। ১০০ বল খেলে ৫৯ রান করে আউট হয়ে ফিরে যাওয়ার আগে মুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে।
সিরিজের পরের ম্যাচেও স্টিভ স্মিথের পরিবর্তে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন লাবুশেন। সেই ম্যাচের দুই ইনিংসে রান করেছিলেন ৭৪ এবং ৮০। সিরিজের ৪র্থ ম্যাচে স্মিথ ফিরলেও তাই লাবুশেনকে বাদ পড়তে হয়নি। বরং দলের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ৩ নম্বর পজিশনটা নিজের করে পেয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই নতুন গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন মার্নাস লাবুশেন।
নতুন গল্প কেন, এর আগে কি পুরোনো কিছু ছিল? হ্যাঁ, এর আগেও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মারনাস ল্যাবুশেন। ২০১৮ সালে আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে প্রথমবারের মত মাঠে নেমেছিলেন মারনাস ল্যাবুশেন। তবে সেবার অভিষেক হয়েছিল লেগস্পিনিং অলরাউন্ডার হিসেবেই।
অভিষেক ম্যাচের দুই ইনিংস মিলিয়ে ১১ ওভার বল করে উইকেট নিয়েছেন একটি। ব্যাট হাতেও সুবিধা করতে পারেননি প্রথম ইনিংসে দুই বলে শূন্য আর পরের ইনিংসে ২৪ বলে মাত্র ১৩ রান করেছিলেন তিনি।
পরের ম্যাচে কিছুটা উন্নতি হয়েছিল ল্যাবুশেনের ব্যাটিংয়ে। সে ম্যাচে তার ব্যাট থেকেই এসেছিল প্রথম ইনিংসের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৪৩। আর পরের ইনিংসে ২৫, যা ছিল ইনিংসের তৃতীয় সর্বোচ্চ। এরপর ভারত সিরিজে মাত্র ১ ম্যাচ খেলেই দলের বাইরে চলে যান এই তরুণ।
ক্যারিয়ারের শুরুটা মনমত হয়নি কিন্তু পরের সুযোগেই করেছেন বাজিমাত। নতুন করে নিজেকে প্রমান করেছেন ল্যাবুশানে। বর্তমানে আইসিসি টেস্ট ব্যাটসম্যানদের র্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে আছেন তিনি। গত কয়েক বছরে অজি টেস্ট একাদশের নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠেছেন তিনি।
এখন বলতে গেলে স্টিভেন স্মিথ আর মার্নাসই এখন দলের ব্যাটিং-স্তম্ভ। নিজের ২৬ টেস্ট ম্যাচের ক্যারিয়ারে ল্যাবুশেন করেছেন ২৩৯০ রান। গড়টা ৫৪ এর উপরে। ১৩টি হাফসেঞ্চুরির বিপরীতে আছে ৬টি সেঞ্চুরি এবং একটি ডাবল সেঞ্চুরি।
পরিসংখ্যানে আসলে ফুটে উঠে না লাবুশেনের পুনর্জন্মের সব। নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ ম্যাচে তার ব্যাটিং গড় ছিল বিশের একটু ওপরে। অথচ ২০২১ সালের পর থেকে সেই মারনাস রান করেছেন ৬০ এর কাছাকাছি ব্যাটিং গড়ে। এছাড়া রান করার ধরন এবং টেকনিকের দিক থেকে ল্যাবুশেন ২.০ কেই দেখছে এখন বিশ্ব।
২০২০ এর শুরুতে পঞ্চাশ ওভারের ফরম্যাটেও অভিষেক হয়েছিল লাবুশেনের। এই ফরম্যাটে আহামরি কিছু করে দেখাতে না পারলেও বিশ ম্যাচে রান করেছেন ৬৪৬। প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি স্ট্রাইক রেটের সাথে আছে চারটি ফিফটি এবং একটি সেঞ্চুরি।
দলের সেরা ব্যাটসম্যানের ইনজুরিও যে বয়ে আনতে পারে আশীর্বাদ – তার প্রমাণ মার্নাস লাবুশেন। সেদিন স্মিথের সাথে ওমন কিছু না ঘটলে হয়তো তার নামই জানা হতো না অনেক ক্রিকেট ভক্তের। তবে স্রেফ ভাগ্যের জোরে এতদূর এসেছেন লাবুশেন সেটি মোটেও নয়। অসম্ভব পরিশ্রমী এই ব্যাটারের সবটুকু জুড়ে শুধুই ক্রিকেটে। দৃঢ়-প্রত্যয়ী লাবুশেন প্রায় সময়ই নিজের উন্নতিতে লেগে থাকেন। এত চেষ্টা আর শ্রম নিশ্চয়ই বিফলে যেতে পারে না।
মজার ব্যাপার, এই মারনাস লাবুশেনের জন্ম কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় নয়, এমনকি তিনি বংশগতভাবেও অজি নন তিনি। ১৯৯৪ সালের ২২ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লার্কসডর্পে জন্মগ্রহণ করেছিলেন লাবুশেন। কিন্তু তার বয়স যখন দশ বছর, তখন তাদের পুরো পরিবার চলে এসেছিল অস্ট্রেলিয়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট প্রেমীদের নিশ্চয়ই একটু আফসোস হচ্ছে, এমন একজন ব্যাটার হয়তো তাদের হয়েই খেলতে পারতেন।
২০১৪ সালে কুইন্সল্যান্ডের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয় মারনাস লাবুশেনের। অভিষেক ম্যাচেই অ্যাডিলেডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৮৩ রান করেন ল্যাবুশেন। ধীরে ধীরে তিনি বিকশিত হতে থাকেন ব্যাটসম্যান হিসেবে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আসর শেফিল্ড শিল্ডে ২০১৭-১৮ সিজনে লাবুশেনের সংগ্রহ ছিল ৪০ গড়ে ৭৯৫ রান, হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকের ৪ বছর পর গায়ে জড়িয়েছিলেন জাতীয় দলের জার্সি।
ক্যারিয়ারে মাত্র ১২ টেস্ট খেলেই টেস্ট ব্যাটসম্যানদের সেরা দশে ঢুকে গিয়েছিলেন লাবুশেন। এরপর ২৩ ম্যাচ শেষে ৯৩৫ রেটিং নিয়ে দখল করেছিলেন ১ নাম্বার পজিশনও। অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ইয়ান চ্যাপেল লাবুশেনের সাথে তুলনা করতে গিয়ে শুধু রিকি পন্টিং আর মাইকেল ক্লার্কের কথাই বলেছেন। এভাবেই রান করতে থাকলে হয়তো ক’দিন পর আরো উঁচুতে শোনা যাবে লাবুশেনের নাম।
জো রুট, স্মিথ, কোহলিদের যুগে খেলা কোন ব্যাটসম্যানও যে দর্শকদের আগ্রহ নিজের দিকে টেনে নিতে পারবেন তা হয়তো ল্যাবুশেনের দেখার আগ অবধি কেউ বিশ্বাস করতে পারতো না। লাবুশেন যে এখনই কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে এমনটাও নয়।
মাত্র ২৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে তো আর বিচার করা যায় না, কিন্তু এই স্বল্প সময়ে যে ব্যাটিং ঝলক দেখিয়েছেন মার্নাস লাবুশেন সেটি সময়ের সাথে সাথে আরো বাড়বে বলেই প্রত্যাশা করা যায়। আর ব্যাটিং শিল্পীর সেই তুলি হাতে ঝলকানি মুগ্ধ হয়েই উপভোগ করবে সবাই।