এই কী শান্তর পথচলা শুরু!

প্রচণ্ড বাতাসে সেখানে তিষ্টোনো দায়। কাছের লোকটা কথা বললেও ঠিকমতো শুনতে পাওয়া যায় না।

তিনি যখন ‘আজকে না’ বললেন, বাতাসের গর্জনে কথাটা বোঝা গেলো না। আরেকবার কথাটা শোনার জন্য প্রশ্ন করতে হলো, ‘একটু কথা বলা যাবে, শান্ত?’

তিনি লজ্জা পেয়েই এবার আর ‘না’ করতে পারলেন না। দাড়িয়ে পড়লেন। একটু কথা বললেন। খুবই শান্ত ধরণের কথাবার্তা। কথায় কোনো আলাদা আক্রমনাত্মক ব্যাপার স্যাপার নেই। তবে একটা দারুন দৃঢ়তা আছে। মনে হলো, রেকর্ডগুলো তার এমনি এমনি কাছে আসেনি। তার ভেতর কিছু একটা আছে।

হ্যাঁ, কিছু একটা আছে বলেই লম্বা সময় ধরে বাংলাদেশের বাজির ঘোড়া এই নাজমুল হোসেন শান্ত।

মহাকালের বিচারে ১৪টা আর্ন্তজাতিক ম্যাচ এমন কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সমর্থকরা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। বারবার তাকে সব ফরম্যাটে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো-আর কতো? আর কবে এই আস্থার প্রতিদান দেবেন শান্ত?

অবশেষে শ্রীলঙ্কার পাল্লেকেলেতে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করে অন্তত প্রতিদানের ইঙ্গিত দিলেন শান্ত। বোঝালেন, তিনি পারলেও পারতে পারেন।

শান্তকে দেখলেই আমার কক্সবাজারের সেই ঝড়ো বিকেলটার কথা মনে পড়ে।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের কথা। শান্ত তখন যুব ক্রিকেটের মেগাস্টার। এই টুর্নামেন্টেই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে যুব বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করেছেন। পাকিস্তানের আসলাম সানিকে পার করে যুব ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের মালিক হয়েছেন। ফলে তার সাথে একটু কথা বলে স্টোরি করাটা দায়িত্ব হয়েছে।

সমস্যা হলো, শান্তকে পাওয়া যায় না।

অনুশীলন শেষে সব ক্রিকেটার একটু বসে আরাম করেন। শান্তকে এই সময় ধরার উপায় নেই। তিনি একটু বাড়তি অনুশীলন করেন। এরপর হঠাৎ ‘নেই’ হয়ে যান। অবশেষে মেহেদি হাসান মিরাজের মাধ্যমে তাকে ধরা গেলো। তাও প্রথম দফা ‘না’ করেছিলেন। পরে লজ্জা পেয়েই কথা বললেন।

সেই থেকে একটা ব্যাপার জানি, শান্ত নিজের কাজটা খুব মন দিয়ে করতে পারেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে শান্তকে ‘ভবিষ্যৎ অধিনায়ক’ মনে করি না। কিন্তু বিসিবি সেটা মনে করে। ফলে তাকে ফিউচার স্টারের পাশাপাশি ফিউচার ক্যাপ্টেন হিসেবেও গড়াপেটার কাজ চলছে। তার পেছনে প্রতিনিয়ত আস্থা বিনিয়োগ করছে বিসিবি।

শান্তর প্রতি আমাদের ব্যক্তিগত অনুরাগ নেই। কিন্তু শান্তর জ্বলে ওঠাটা প্রয়োজন ছিলো। কারণ, সব ভবিষ্যত তারকাকে এমন যত্ন নিয়ে গড়ে তোলা হয় না। তার ভেতরে অসম্ভব সম্ভাবনা আছে বলেই তাকে নিয়ে এতো কাজ করা হচ্ছে। তাকে এতো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

এখন শান্ত ব্যর্থ হলে একটা সিস্টেম, একটা আশাবাদ ব্যর্থ হয়ে যেতো।

এই যে ভবিষ্যত তারকাদের গড়ে তোলা এবং তাদের আস্থায় রাখার যে ধারাটা বিসিবি চালু করেছে, এটা ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য খুব জরুরী। সমর্থকরা অল্পেই অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন; এটা স্বাভাবিক। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট কাউকে এতো সহজে ছুড়ে ফেলবে না। তারা দিনের পর দিন একজনকে সুযোগ দেবে তার সম্ভাবনা দেখে। এরপরও যদি না হয় বাদ দিতে হবে এবং আবার গোড়া থেকে প্রস্তুত হয়ে আসতে হবে।

এই ব্যাপারটা শান্তর ক্ষেত্রে হয়েছে। তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

সেই চান্দিকা হাথুরুসিংহের সময় থেকে তাকে তৈরী করা হচ্ছে। জাতীয় দলের পরিবেশ বোঝানোর জন্য তাকে নিউজিল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। পরে দলের বিপাকে মাঠেও নেমে পড়তে হয়েছিলো তাকে। সেই থেকে একবারও আমাদের ম্যানেজমেন্ট শান্তর ওপর আস্থা হারায়নি।

এখন দেখার ব্যাপার ছিলো যে, কত দিন এই আস্থাটা ধরে রাখা যায়। হয়তো এই শ্রীলঙ্কা সফর শান্তর জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা হতে পারতো। এখানে ব্যর্থ হলে তার পক্ষে সম্প্রতি আর স্কোয়াডেই জায়গা পাওয়া কঠিন হতো। ফলে এটা নিজের জন্য শেষ সুযোগের শুরু ভাবতে পারতেন শান্ত।

আর সেই ভাবনাটা থেকে থাকলে দারুণভাবে ঘুরে দাড়িয়েছেন তিনি।

হ্যাঁ, উইকেট একেবারে ব্যাটসম্যানদের জন্য প্রস্তুত ছিলো। মঞ্চটা শান্তর জন্য সাজানোই ছিলো। সেটাকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। এখন এই রানটা নিয়মিত করে যেতে হবে। তবেই আমরা শান্তর জয়গান গাইতে পারবো।

তবে এই ইনিংস দিয়ে শান্ত একটা কাজ করেছেন। প্রায় ৮ বছর পর প্রথম কোনো তিন নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে দেশের বাইরে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন।

তিন নম্বরে সেই হাবিবুল বাশারের পর থেকে আমরা আর থিতু কোনো ব্যাটসম্যান পাইনি। মুমিনুল হক তিন নম্বরে না থেকে বরং চার নম্বরে চলে গেলেন। ফলে এই জায়গাটাও পূরণ করা একটা দায় ছিলো। এখন শান্তর চ্যালেঞ্জের মধ্যে এটাও একটা। বাংলাদেশকে টপ অর্ডারে একটা স্থিতিশীলতা এনে দিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link