সাদা হাতি নয়, লম্বা রেসের ঘোড়া

লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন এমন একটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, যে দেশে লেগ স্পিনারদের কোনো কদরই নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সংগঠক ও প্রশিক্ষকরা লেগ স্পিনারদের ‘সাদা হাতি’ বলে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করলেও কাজের বেলায় তাঁদের সেই বিশ্বাসের প্রতিফলনটা ঠিক দেখা যায় না।

সবশেষ বিপিএলের কথাই ধরা যাক। তখন বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি দলের নিয়মিত সদস্য রিশাদ। তা সত্ত্বেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে চৌদ্দ ম্যাচের মধ্যে মাত্র চারটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি।

আরও এক বছর পেছনে তাকাই। ২০২৩ ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে প্রাথমিকভাবে কোনো দল পাননি রিশাদ। শেষমেশ টুর্নামেন্ট শুরুর প্রাক্কালে তাঁকে দলে ভেড়ায় আবাহনী।চাঁচাছোলাভাবে বলতে গেলে, তাঁর দল পাওয়াটা অনেকটা দয়াদাক্ষিণ্যের দরুন।

সে সময় আবাহনীর কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন রিশাদকে দেরি করে দলে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানান, রিশাদ দল না পেয়ে মন খারাপ করবে বলে না কি তাঁকে দলে নিয়েছেন তিনি। তবে দল পেলেও রিশাদ ম্যাচ খেলতে পান মাত্র দুটি, যেখানে তাঁর দল আবাহনী ম্যাচ খেলেছিল মোট ষোলোটি।

এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ২০১৯ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিটা দলের একাদশে অন্তত একজন করে লেগি খেলানোর নিয়ম করে দিলেও তা মানা হয়নি।

সে বার জাতীয় লিগে রংপুর বিভাগের একাদশে রিশাদ হোসেনকে না রাখায় বরখাস্ত হন দলটির প্রধান কোচ মাসুদ পারভেজ রাজন। তাছাড়া বোর্ড সভাপতি কর্তৃক ওই বছরের বিপিএলে প্রত্যেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির একাদশে অন্তত একজন করে লেগ স্পিনার খেলানো এবং পুরো চার ওভারের কোটা পূরণ করার কথা বলা হলেও তা কানেই তুলেনি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি।

আসলে বাংলাদেশে লেগ স্পিনারদের এ-রকম অবহেলার শিকার হওয়ার কথা লিখতে শুরু করলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ শেষ হয়ে যাবে। এর পেছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ হচ্ছে আমাদের ক্রিকেট পাড়ায় একটা বদ্ধমূল ধারণার অস্তিত্ব বিদ্যমান। সেটা হলো, ‘লেগ স্পিনাররা খরুচে।’ ঠিক এই কারণেই এ দেশে বছরের পর বছর ধরে অবহেলার শিকার হয়ে আসছে লেগিরা।

মোটাদাগে এই হচ্ছে আমাদের দেশে লেগ স্পিনারদের প্রচলিত হালচাল। আমি যতটুকু জানি, রিশাদ নামের অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটা হলো সরল পথ। কিন্তু রিশাদের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে পাড়ি দেওয়া পথটা যে মোটেই সরল ছিল না, তা নিশ্চয় এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এ দেশের লেগ স্পিনবিরোধী ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির মাঝেও একজন তরুণ লেগি নিজের প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে নেমেই ম্যাচ সেরা হয়েছেন, ভাবতেই শিহরন জাগছে।

ডালাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিশ্বকাপ অভিষেকেই এক ভয়ানকরূপে দেখা গিয়েছে রিশাদ হোসেনকে। সত্যি বলতে, তাঁকে বল হাতে এতটা ভয়ঙ্কররূপে আমি আগে কখনও দেখিনি। রিশাদকে আমি দেখে আসছি ২০১৮ সাল থেকে।

শেরে বাংলায় তখন যুব এশিয়া কাপ সেমিফাইনালে খেলছিলেন তিনি। প্রথম দেখায় তাঁর ব্যাপারে আমার অনুভূতি ছিল এরকম – লম্বা একজন লেগি, কন্ট্রোল মোটামুটি, ডেলিভারিগুলো মাঝেমধ্যে হালকা বাঁক নেয় এবং উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে বেশ ভালো বাউন্স আদায় করতে পারেন।

ছয় বছর পর সেই রিশাদ ৩.৬ ডিগ্রি বাঁক পেয়েছেন, যা চলতি বিশ্বকাপে গ্র্যান্ড প্রেইরির উইকেটে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। দারুণ নিয়ন্ত্রণের সাথে কখনো বলকে ফ্লাইট দিয়ে বাঁক খাইয়ে আবার কখনও একটু জোরের ওপর করে ব্যাটারদের জীবন দুর্বিষহ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।

ফলশ্রুতিতে শেষ ছয় ওভারে নিজের দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসেই ২ ওভারে মাত্র ৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট তুলে নেন তিনি। বিশেষ করে, উইকেটে জমে যাওয়া ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে আউট করার ধরণটা তো দীর্ঘকাল চোখে লেগে থাকতে বাধ্য।

একটা শার্প ফ্লাইটেড লেগব্রেককে সামনের পায়ে চার্জ করতে আসলে পেছনের পা পপিং ক্রিজের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ায় লিটনের তড়িৎগতির গ্লাভওয়ার্কে স্টাম্পড হয়ে সাজঘরের পথ ধরেন তিনি। তাছাড়া ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার আউটাও ছিল দেখার মতো। লেগ স্টাম্পের বাইরে বল পিচ করে বাঁক খাওয়ার সময় ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপে সৌম্যর হাতে ক্যাচ ওঠে যায় তাঁর। সব মিলিয়ে রিশাদ ৪ ওভার বল করে ২২ রান খরচায় ৩ উইকেট তুলে নেন।

রিশাদ হোসেন টি-টোয়েন্টি দলের সাথে আছেন প্রায় পনেরো মাস যাবৎ। ইদানীং একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তিনি খেলতে শুরু করেছেন। লেগিদের আকালে ভোগা এবং তাঁদের প্রতি বরাবরই বিমাতাসুলভ আচরণ করা বাংলাদেশ ক্রিকেট সংস্কৃতির মাঝেও যেন এক ‘লম্বা রেইসের ঘোড়া’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। এই ‘ঘোড়া’-র দৌড় দীর্ঘ হোক এবং দৌড়ের পথটা নিজের নামের অর্থের মতোই সহজ ও সরল হোক- এমনটাই প্রত্যাশা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link