কোটি টাকার প্রতিদান লালকার্ডে

প্রিয় খেলোয়াড়কে দেখার জন্য আপনি কী করতে পারেন? জিনেদিন জিদান কিংবা লিওনেল মেসিকে এক পলক দেখবার জন্য বাংলাদেশের মানুষের উত্তেজনা নিশ্চয় ভুলে যাননি। অনেকে তো লাখ লাখ টাকা খরচ করে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেন প্রিয় খেলোয়াড়কে সামনাসামনি একদণ্ড দেখবার জন্য। কিন্তু নিজ দেশে থেকেই প্রিয় খেলোয়াড়কে মাঠে দেখবার জন্য কোটি টাকা খরচ করে যদি ফলাফল হয় লালকার্ড? তবে কেমন লাগবে? ইন্টারন্যাশিওনাল সমর্থক ম্যাগি শেফারের এখন তেমনটাই লাগচ্ছে বৈকি।

ঘটনার একদম গোড়া থেকে শুরু করা যাক। যে খেলোয়াড়কে নিয়ে ঘটনা নাম তাঁর রোডনি। ২৯ বছর বয়সী এই খেলোয়ার ব্রাজিলিয়ান লিগে বেশ জনপ্রিয় না হলেও মোটামুটি জনপ্রিয়ই বটে। রাইট ব্যাক হিসেবে নিজের দলে নামও কামিয়েছেন। ফ্লামেঙ্গোতে আছেন ৫ মৌসুম ধরে। কিন্তু গত মৌসুমের শুরুতে তাকে দুই মৌসুমের জন্য ধারে আনে ইন্টারন্যাশিওনাল। কিন্তু ধার নেওয়ার সময় শর্ত ছিল, সে তার প্যারেন্ট ক্লাবের বিপক্ষে মাঠে নামতে পারবে না।

বর্তমান ফুটবলে একই লিগে কোনো খেলোয়াড়কে ধারে দিলে এমন শর্ত দেওয়া হয়ে থাকে। যে খেলোয়াড়কে নিজেরাই অন্য দলে পাঠিয়ে দিয়েছে, তার জন্য কুড়াল খেতে কে-ই বা চায়? ফ্লামেঙ্গোও চায়নি। কিন্তু চুক্তিতে ছোট্ট একটা শর্ত রেখেছিল তারা। যদি তারা একান্তই চায় ফ্লামেঙ্গোর বিপক্ষে খেলাতে, তবে তাদেরকে মোট এক মিলিয়ন রিয়াল (ব্রাজিলিয়ান মুদ্রা) কিংবা ১.৮৫.০০০ ডলার পরিশোধ করে তাকে খেলাতে হবে। বাংলাদেশি মূল্যমানে যা ১ কোটি ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এক ম্যাচ খেলানোর জন্য কোনো পাগলও এতো টাকা পরিশোধ করতে যাবে না।

কিন্তু সময়ের প্রয়োজন বলে কথা। ব্রাজিলিয়ান লিগের বাকি আর দুই ম্যাচ। ৪০ বছর পর ব্রাজিলিয়ান সিরি ‘এ’ জয়ের দ্বারপ্রান্তে ইন্টারন্যাশিওনাল। পয়েন্ট টেবিলে ফ্লামেঙ্গোর চেয়ে এগিয়েও আছে ১ পয়েন্টের ব্যবধানে। এমন সময় যদি ক্লাবের নিয়মিত রাইট-ব্যাককে ছাড়া মাঠে নামে, তবে কি হয়? ব্যাক-আপ রাইট ব্যাকও মাত্র উঠে এসেছে যুবদল থেকে।

তাই রোডনিকে ছাড়া মাঠে নামা সোজা ছিল না ইন্টারন্যাশিওনালের কাছে। দলের প্রয়োজনেই তো সমর্থক এগিয়ে আসে। চার দশকজুড়ে যে শিরোপার আকাঙ্ক্ষা, তার কাছে এই ক’টা টাকা যে নস্যি। ইন্টারন্যাশিওনাল সমর্থক ম্যাগি শেফার তাই ম্যাচের দুইদিন আগে চিঠি লিখলেন দলের কাছে, ‘একজন কোলরাডো দ্যানের কাছ থেকে উপহার। টাকাটা দিয়ে রোডনিকে খেলানোর বন্দোবস্থ করো।’

ক্লাবও এমন মোটা অঙ্কের ডোনেশন পেয়ে কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল, ভেবেছিল কেউ এমন মজা করছে। কিন্তু ঘটনা তলিয়ে দেখে যখন জানা গেল না, সত্যিই এক সমর্থক নিজের পকেট থেকে মিলিয়ন রিয়াল চেক দিয়েছেন, তখন তড়িঘড়ি করে অ্যাক্টিভেট করলো ‘রোডনি ক্লজ’। যার আওতায় ফ্লামেঙ্গোর বিপক্ষে মাঠে নামতে পারবেন রোডনি। বেঁচে থাকবে ইন্টারন্যাশিওনালের চারদশক পর শিরোপার স্বপ্ন।

ফ্লামেঙ্গোর মাঠে প্রথমার্ধ ভালোই চলছিল, ১-১ গোলে সমতা। শিরোপার লড়াইয়ে কেউ কাউকে নাহি ছাড়ে সমানে-সমান। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসেই ভুল করে বসলেন রোডনি, ডি-বক্সের সামান্য বাইরে থেকে ফেলে দিলেন ব্রাজিলিয়ান লেফট ব্যাক ফিলিপে লুইজকে। প্রথম চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল রেফগারির। কিন্তু ফ্লামেঙ্গোর খেলোয়াড়দের জোড়াজুড়িতে ‘ভিএআর’ চেক করেই দেখা গেল মূল ঘটনা। ফিলিপে লুইসের গোড়ালিতে সরাসরি ফাউল করেছেন রোডনি! ফলাফল লালকার্ড! ৪৯ মিনিটে মাঠ ছাড়েন রোডনি।

এরপরই যেন ম্যাচের হটসিটে বসে ফ্লামেঙ্গো। একের পর এক আক্রমণে দিশেহারা করে দেয় ইন্টারন্যাশিওনালকে। গোলও পেয়ে যায় ৬৩ মিনিটে। গাব্রিয়েল বারাবোসার পা থেকে আসা এই গোল হয়ে যায় ম্যাচের ডিসাইডার। ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় ফ্লামেঙ্গো।

ম্যাচের আগে এক পয়েন্ট পেছনে থাকা ফ্লামেঙ্গো এখন লিগ লিডার। ২ পয়েন্ট এগিয়ে থাকা ফ্লামেঙ্গোর জন্য টানা দ্বিতীয়বার ব্রাজিলিয়ান সিরি-আ জেতার সূবর্ণ সুযোগ। তাই বলে ইন্টারন্যাশিওনালের সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়নি। এখনও চার দশক পরে জেতার সামান্য সম্ভাবনা আছে, তবে সেটা পুরোপুরি ফ্লামেঙ্গোর উপরে।

শেষ ম্যাচে যদি ফ্লামেঙ্গো হার কিংবা ড্র করে বসে তবেই জেতার সুযোগ হবে তাদের। গোল ব্যবধানে এগিয়ে আছে, শুধু অপেক্ষা ফ্লামেঙ্গোর হারের। অন্যদিকে দলের সেরা ডিফেন্ডার রোদনি নিষিদ্ধ হয়েছেন তিন ম্যাচের জন্য। অর্থাৎ ডিসাইডিং ফাইনাল চাইলেও তাকে ম্যাচ দেখতে হবে বাসা থেকে। এর থেকে কষ্টের বস্তু আর কী-ই বা হতে পারে তার জন্য?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link