রদ্রিগো, রিয়ালের লাকি চার্ম

আপনি যদি ঘুম থেকে উঠে দেখেন রিয়াল মাদ্রিদ আবারো প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখেছে, গল্পের নায়ক হিসেবে আপনার ভাবনায় যে নামটি প্রথমেই আসতে পারে সেটি করিম বেনজেমা। ভিনি জুনিয়র কিংবা লুকা মদ্রিচের নামটিও হয়তো এরপর ভাবা যেতে পারে এমন ম্যাচের কাণ্ডারি হিসেবে।

তবে আপনার অনুমান ভুল প্রমাণ হবে ম্যাচের স্কোরশিট দেখার পরে। না, বেনজেমা কিংবা ভিনি জুনিয়র নয়, রিয়াল মাদ্রিদের আরো একটি অবিশ্বাস্য জয়ের নায়ক একজন ব্রাজিলিয়ান, তিনি রদ্রিগো সিলভা দি গোয়েস।

রদ্রিগো অবশ্য ম্যাচের শুরুর একাদশে ছিলেন না। মাঠে এসেছেন প্রায় সত্তর মিনিটের মাথায়। মাঠে দাঁড়িয়েই দেখেছেন ম্যানচেস্টার সিটির রাইট উইঙ্গার রিয়াদ মাহরেজের দুর্দান্ত গোলে ফিকে হয়ে উঠেছে মাদ্রিদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলার স্বপ্ন।

রদ্রিগো নিজেও একজন রাইট উইঙ্গার, আরেক রাইট উইঙ্গারের এমন সাফল্য সহ্য হয়নি। তরুনের তাজা প্রান তখন কবি নজরুলের ‘কে ধরিবে হাল’ এর কাল্পনিক ডাকে সাড়া দিয়েছে।

ঠিক নব্বই মিনিটের মাথায় সিটি’র রক্ষনে রদ্রিগো’র প্রথম আঘাত। এরপরের মিনিটেই আবারো প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠান তিনি। মাত্র দুই মিনিটের ঝড়ে দুই গোল করে ২১ বছর বয়সী রদ্রিগো একাই গুঁড়িয়ে দেন ইংলিশদের দম্ভকে। এরপর অতিরিক্ত সময়ে বেনজেমা’র সফল পেনাল্টির কল্যানে জয় পায় লস ব্ল্যাঙ্কোস’রা। স্বপ্নের ফাইনালে জায়গা করে নেয় তাঁরা।

বেঞ্চ থেকে এসে ম্যাচ ভাগ্য বদলে দেয়ার ঘটনা রদ্রিগো’র জন্য এবারই প্রথম নয়। শুরটা মৌসুমের প্রথমদিকে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বেই। ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ম্যাচে সেদিন গোল শুন্য ড্র করতেই যাচ্ছিলো রিয়াল মাদ্রিদ, কিন্তু বেঞ্চ থেকে আসা রদ্রিগো গোল করে মূল্যবান তিনটি পয়েন্ট এনে দেন লস ব্ল্যাঙ্কোসদের।

এরপর আবার রাউন্ড অব সিক্সটিনে প্যারিস সেন্ট জার্মেই এর বিপক্ষে সেই প্রত্যাবর্তনের পিছনের নায়কদের একজন ছিলেন রদ্রিগো। চেলসির বিপক্ষে জয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য একেবারে সামনের সারি’র একজন ছিলেন রদ্রিগো। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকা রিয়াল মাদ্রিদের প্রথম গোল করেছিলেন তিনি, এরপরই ঘুরে দাঁড়ায় স্প্যানিশ ক্লাবটি।

এছাড়া ঘরোয়া লা লিগার ম্যাচে যে রিয়াল প্রথমার্ধে পাত্তাই পায়নি সেভিয়ার কাছে সে রিয়ালের মানসিকতার পুরোটাই যেন বদলে দেন রদ্রিগো গোয়েস। তার উপস্থিতিতে যেন নতুন উদ্যমে রিয়াল উদ্দীপ্ত হয়ল উঠে। তার এক গোল এবং একট অ্যাসিস্টে সেভিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে পিছিয়ে থেকে ৩-০ গোলের জয় পায় দলটি।

মাঠে নিজেকে ঢেলে দেয়া, সতীর্থদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করা কিংবা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয়ার কাজগুলো বাম হাতের খেল-এ পরিণত করে ফেলেছেন রদ্রিগো। যেন এসবই তার অভ্যাস। সমালোচক মাত্রই বলতে বাধ্য, রদ্রিগো তৈরি করা হয়েছে এমন চাপের ম্যাচগুলোর জন্য।

আর রদ্রিগোর এই সুপার সাব বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ ফায়দা তুলে নিতে পেরেছেন রিয়াল মাদ্রিদের গুরু কার্লো আনচেলত্তি। ঠিক ঘড়ির কাঁটা মেপে তিনি মাঠে নামান রদ্রিগো গোয়েস’কে। শিষ্যের সাফল্যের এমন পারফরম্যান্সের একটি অংশ তাই ইতালিয়ান মাস্টারমাইন্ডকে দিতেই হবে।

রদ্রিগো ছাড়াও আরেকজন সুপার সাবস্টিটিউটের কথা বলতে হয়। তিনি এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা। রদ্রিগো’র মত এই ফ্রান্স তরুনও চাপের সময় কোচের ভরসা হয়ে উঠেছেন। সেই শুরুর ইন্টার মিলানের বিপক্ষে রদ্রিগো’র গোলের অ্যাসিস্ট এসেছিল তার পা থেকেই।

তাছাড়া পিএসজি, চেলসি কিংবা ম্যানসিটি ম্যাচেও তার অবদান অনস্বীকার্য। ম্যাচের স্কোরলাইনে তাকিয়ে সেটি বোঝা না গেলেও ম্যাচগুলো দেখা প্রতিটি চোখ জানে একজন কামাভিঙ্গা কিভাবে ঠান্ডা মাথায় মধ্যমাঠ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে দু’দলের মাঝমাঠের যুদ্ধে নিজের দলকে জয় এনে দেন।

রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি আলভারো আরবেলোয়া একবার বলেছিলেন, ‘এটাই রিয়াল মাদ্রিদ। যখন সবাই মনে করে আমরা মৃত এবং কবর দেয়া হয়েছে, তখনই আমরা যাই এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতি।’ আরবেলোয়ার এই কথা রদ্রিগো, কামাভিঙ্গা-সহ সাদা পোশাকের অল হোয়াইট দলটির প্রত্যেকে বারবার প্রমান করে দেন। প্রমান করে দেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়ালের আভিজাত্য।

না, আজকের ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার অবশ্য রদ্রিগো গোয়েস পাননি। বরং বলা যায় তার সতীর্থ থিবো কোর্তায়াই তাকে পেতে দেয়নি এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স দেখানো সত্ত্বেও। আট আটটি সেভ করে কোর্তায়া দলকে যে পথ দেখিয়েছেন স্বপ্নের ফাইনালের দিকে।

কাগজে-কলমে ম্যাচের নায়ক রদ্রিগো না হলেও, ভক্তদের চোখে তিনি নিশ্চিত ভাবেই একজন স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট একজন। আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম বাদে ভক্তদের কোনো আসরে যদি রিয়াল মাদ্রিদের এমন কামব্যাক হিস্টোরি নিয়ে আলোচনা হয়, নিশ্চিতভাবেই স্মৃতির পাতার মলাট খুলতেই ইতিহাস খুঁজে নেবে রদ্রিগো গোয়েস’কে।

স্মৃতিতে ভেসে উঠবে রদ্রিগোর রূপকথা। আর এমন ফর্মের ধারবাহিকতা ধরে রাখলে নিঃসন্দেহে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে যাবে একজন রদ্রিগোর গল্প; সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের সবুজ ঘাসে নিবেদিত এক আত্মার গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link