২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক তাঁর। তিনিই বর্তমান ভারতীয় দলের একমাত্র সদস্য যিনি ফ্যাব ফোরের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করেছেন।
প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছিলেন ২০০৭ সালের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। তারপর সৌরভ-দ্রাবিড় একদিনের দল থেকে বাদ পড়ার পরে দায়িত্ব নিয়ে শচীন-ধোনী-গম্ভীর-যুবরাজের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রথমবারের মত জিতিয়ে ফিরেছিলেন একদিনের সিরিজ়।
প্রথম আইপিএলে হায়দ্রাবাদের হয়ে একা কুম্ভ হয়ে রানের ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছিলেন রোহিত। খুব তাড়াতাড়ি ভারতীয় দলে নিয়মিত হয়ে গেলেও কোথাও যেন তাঁর প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারছিলেন না। ইতিমধ্যে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে যোগ দিয়েছেন। মাঝে হয়ে গিয়েছে আরও দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, খুচখাচ রান পেলেও রোহিত সুলভ পারফরম্যান্স আসেনি তখনও তাঁর ব্যাট থেকে।
ফলে ২০১০ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়ার কথা থাকলেও চোট আর শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত কারণগুলো পেরোতে বেশ সময় লেগেছিল রোহিতের। একদিনের দলে কখনও থাকতেন আবার কখনও নয়। ভাল শুরু করেও কোহলি বা ধোনিকে শুধুমাত্র একটা সাপোর্টিভ স্ট্যান্ড দিতে পারার থেকে বেশি কিছু করতে পারবেন বলে কেউই আর ভাবত না রোহিতকে নিয়ে।
বিশাল মাপের প্রতিভা নিয়েও রোহিত চোখের সামনে দেখছিলেন একে একে কোহলি ও ধোনির উত্থান, গম্ভীর শেবাগের দাপট, রাহানের উচ্চকিত প্রবেশ – আর তিনি? সব হারিয়ে হতাশার শেষ সীমানায় পৌঁছে যাওয়া এক ক্ষণস্থায়ী স্ফুলিঙ্গ, নিভে যাওয়ার আগে যেন বলতে চাইছিলেন, ‘কেন পারলাম না? আমার মধ্যে তো কোনো কিছুর অভাব ছিল না!’
বোধহয় তাঁর অকাল প্রস্থানের উপযুক্ত চিত্রনাট্য তৈরি করতেই দেশের মাটিতে হতে চলা একদিনের বিশ্বকাপ দলেও জায়গা হল না তাঁর। যদিও ঘষটাতে ঘষটাতে তারপরেও রোহিত টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর ক্যারিয়ার, তবুও এক একবার ভাবতেনও খেলা ছেড়ে দেবেন!!
কিছু ঘটনা না ঘটলে না কী বোঝা যায় না, পরবর্তীতে কি লুকিয়ে রেখেছিল ভবিষ্যত। ১৯৯৬ সালের ইংল্যান্ড সফরে সিধু আজ়হারউদ্দীন ঝামেলা আর সঞ্জয় মাঞ্জরেকরের অফফর্ম ও চোট যেমন সৌরভ-দ্রাবিড় জোড়া ফলার আন্তর্জাতিক অভিষেক ঘটিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটকে নবজন্ম দান করেছিল, তেমনই ঘটেছিল ২০১৩ সালে।
বোর্ড ও শেবাগের ঝামেলায় শেবাগ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে যান, গম্ভীর একদিনের দল থেকে বাদ পড়েন ধারাবাহিকতার অভাবে। রোহিত তখনও অবধি মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ক্যাপ্টেন হিসাবে ট্রফি জিতেছেন। ধোনীর আচমকা মনে হয় আসন্ন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখলে কেমন হয়?
ততদিনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্টে চমকপ্রদ সেঞ্চুরী করে নিজের কেরিয়ারকে কবর থেকে বের করে তাল ঠুকছেন আরেক নতুন ওপেনার শিখর ধাওয়ান। আইপিএল ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িয়ে চেন্নাই সুপার কিংস সাসপেনশনে চলে যাওয়ায় অধিনায়ক ধোনির কাছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতাটাই হতে পারত এই বিতর্ক সরিয়ে সম্মান পুনরুদ্ধারের তুরুপের তাস। ইংল্যান্ডের মাটিতে তাই ধোনীর নেতৃত্বে প্রথমবারের জন্য নিয়মিত ওপেনার হিসাবে ধাওয়ানের সঙ্গে মাঠে নামলেন রোহিত গুরুনাথ শর্মা, বাকিটা ইতিহাস।
এরপরেও টেস্ট অভিষেকে পরপর সেঞ্চুরী করে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন রোহিত। যদিও টেস্ট দলে নিয়মিত হতে তাঁর আরো ছয়বছর সময় লাগে। কিন্তু একদিনের আন্তর্জাতিক থেকে শচীনের বিদায়ের পর এক কোহলী ছাড়া যদি কেউ এতটা ধারাবাহিক থেকে দাপিয়ে ব্যাটিং করে থাকেন, তিনি রোহিতই।
ওপেনার না হয়েও মিডল অর্ডার ব্যাট থেকে বিশ্বসেরা ওপেনার অনেকেই হয়েছেন (সনাথ জয়াসুরিয়া বা বীরেন্দ্র শেবাগ অথবা জাস্টিন ল্যাঙ্গাররা)। কিন্তু নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে নিয়েও নিজেকে আমুল পাল্টে এরকম স্ফুলিঙ্গে পরিবর্তিত করতে পারার মত ব্যাটার বিশ্বে বিরল।
ধন্যবাদ অধিনায়ক ধোনি এবং ২০০৭-২০১৩ অবধি থাকা নির্বাচকদের, যাঁরা চিনেছিলেন রোহিতের ক্ষমতাকে। সঙ্গে স্বামী ও বাবা হিসাবে রোহিতের মধ্যে যে পরিণতির ছাপ দেখা গিয়েছে (তাঁর সাফল্যের পিছনে পারিবারিক সুখী জীবনের কথা রোহিত স্বয়ং বারংবার বলে এসেছেন), তার জন্য তাঁর স্ত্রী ও কন্যারও কৃতিত্ব প্রাপ্য!
তাঁর আর সৌরভের সুসম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা হয়, কিছু ব্যঙ্গও থাকে হয়ত তারমধ্যে। অনেকেই জানেন না, অধিনায়ক হিসাবে নিজের শেষ সিরিজ়ের মধ্যেও সৌরভ তাঁর স্বভাবমত উঠতি প্রতিভাদের শর্টলিস্টেড করতে থাকতেন,খোঁজখবর রাখতেন ছেলেদের। রোহিতের নামও ছিল তাঁর সেই তালিকায় (অনুর্ধ্ব ১৬ ক্রিকেটার হিসাবে)।
কে জানে, মহারাজের জহুরী চোখ হয়ত চিনেছিল পল না কাটা হীরেটিকে, যেমন ভাবেই একদিন শেহবাগ-গম্ভীর-যুবরাজ-বাদানী-কাইফ-ধোনীর মত হীরেগুলিকেও চিনতে পেরেছিলেন দাদা!
শচীন অনেক সময়েই বলতেন তাঁর আর চিন্তা নেই যে অবসরের পর মুম্বই ক্রিকেটের আইকন হিসাবে কাকে মানবে লোকে, কারণ রোহিত এসে গিয়েছেন। ২০১৩ সালের আগে অবধি যখন রোহিত কেবলই গ্রেম হিকের ভারতীয় সংস্করণ হিসাবেই খেলে যাচ্ছেন, তখনও শচীন সহাস্যে বলতেন, ‘এখনও আসল রোহিতকে কেউ দেখেন নি। দেখবেন, ক্রিকেটবিশ্ব দেখবে!’ লিটল মাস্টার বোধহয় সেসব কথাগুলো ভেবে এখনও হাসেন নিজের মনে।
ক্রিকেটার হিসাবে দুজনে দুটো আলাদা ফরম্যাটের বিশ্বকাপ জিতলেও রোহিত কোহলীর কেউই অধিনায়ক হিসাবে বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ পান নি এখনও অবধি। ২০১৫, ২০১৯ সালে চুটিয়ে রান করেছিলেন দুই ব্যাটারই..দুবারই দুটো অভিশপ্ত সেমিফাইনালে হারিয়ে যায় তাঁদের স্বপ্ন।
২০২৩ সালের বিশ্বকাপে ব্যক্তিগত ও দলগত – দুভাবেই দুরন্ত খেলেও সেই ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারের ক্ষত তো এখনও দগদগে। পরের একদিনের বিশ্বকাপ আসতে আসতে সেই ২০২৭ সাল। ৩৫ পেরেনো দ্বিমূর্তি ততদিন থাকবেন না হয়ত (কোহলীর ফিটনেস নিয়ে সমস্যা না থাকলেও রোহিতের রয়েছে)। তাই কোহলির কাছে খেলোয়াড় হিসাবে দ্বিতীয়বার আর রোহিতের কাছে অধিনায়ক হিসাবে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতার সুযোগ সম্ভবত শেষবারের মত হতে যাচ্ছে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসরটিই।
অধিনায়ক হিসাবে অনেক পরিণত এখন রোহিত, ব্যাটেও নতুন করে গিয়ার চেঞ্জ করেছেন ২০২২ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর থেকে। গত চারবছরের মধ্যে টেস্ট সেঞ্চুরী করেছেন ইংল্যান্ডে, একদিনের সিরিজ় জিতেছেন। জিতেছেন এশিয়া কাপ, ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছেন দেশের মাটিতে।
টেস্ট সিরিজ় ড্র রেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। দ্বিতীয়বারের মত ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে তুলেছেন ভারতকে। সবার মাঝে উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা বলতে বাংলাদেশে একদিনের সিরিজ়ে আর পরপর দুটি আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে লড়াই করেও হেরে যাওয়া!
ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাটেই সেঞ্চুরি থাকা রোহিত কি পারবেন ক্রিকেটার হিসাবে তাঁকে নবজন্ম দেওয়া ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতই আরেকটি আইসিসি ট্রফি জিতে নিজের বিদায়বেলাকে স্মরনীয় করে রাখতে? ১১ বছর ধরে অধরা থাকা ভারতের আইসিসি ট্রফির অপেক্ষা মেটাতে? সময়ই বলবে সবকিছু!