শিল্পী ভালবাসেন শৈল্পিকতা সৃষ্টিতে, সে তা যে স্থান, কাল, পরিস্থিতিই হোক না কেন।
২০০৭ বিশ্বকাপের ফাইনাল। বয়স ছিল ৯, ক্রিকেট বোঝার পর প্রথম দেখা বিশ্বকাপ ফাইনাল।
এশিয়ান দল বলে শ্রীলঙ্কার প্রতিই ছিল পক্ষপাতিত্ব, বাংলাদেশের বিদায়ের পর অগ্নিচক্ষু মুরালি, নাকের উপর সান্সক্রিম দেয়া স্টাইলিশ ক্যাপ্টেন জয়াবর্ধনে, ভাসদের দেখে বেশ ভাল লাগত। বিশ্বকাপ তাদের কাছেই যে মানায়!
কিন্তু তখনো হলুদ জার্সির যোদ্ধাদের প্রকাণ্ড অশ্বমেধ যজ্ঞের খবর যে অজানা! তাই আমার প্রত্যাশাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে লংকার বদলে লংকাকান্ড ঘটাচ্ছিলেন সেই হলুদ শাসকদের একজন!
তাঁকে যে চরম যুদ্ধে জ্বলে উঠতেই হবে, অস্ট্রেলিয়ার অশ্বমেধ যজ্ঞে যুদ্ধিষ্ঠির যদি হন রিকি পন্টিং, তিনি যে ছিলেন স্বয়ং অর্জুন। তাঁর খেলা প্রতিটি বিশ্বকাপ ফাইনালেই যে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস ছিল।
সেদিন ১৪৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংসটাতে লঙ্কানদের নাকের পানি চোখের পানি এক করে দিচ্ছিলেন! আর জায়গায় দাঁড়িয়ে একেকটা বড় বড় শটে আমার মুখ বারবার হা করিয়ে মশা ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন!
অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষ হবার পর ভাবলাম, ভদ্রলোকের তাণ্ডব বুঝি শেষ হলো, ওরে বাবা! একটু আগে খড়্গহস্ত দানব হলে এখন যে হয়ে উঠেছেন উড়ন্ত বাজপাখি!
তাঁর ব্যাটিং যদি শিল্পীর তুলিতে ফোটানো সুনিপুণ এক চিত্রকর্ম হলে, কিপিং তবে কবির মুগ্ধতা ছড়ানো ছন্দের পসার। শিল্পী যে জানেন কীভাবে গুণমুগ্ধ করতে হয় সবাইকে!
এই শিল্পীর গুণমুগ্ধ নন, অথচ ক্রিকেটের সমঝদার, এমন কথা বললেও আমি মেনে নেব না। শিল্পীকে না চিনলে, সমঝদারি না করলে শিল্পের বিশদ বিশ্লেষক হয়ে কি লাভ বলুন?
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট নামের এই ক্রিকেটশিল্পী যতক্ষণ ক্রিজে থাকতেন, প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে সর্বদাই থাকতে হত তটস্থ। একাই যে গুড়িয়ে দিতে পারতেন, বিধ্বস্ত করতেন প্রতিপক্ষকে। তাঁর এক তুলির আঁচড় যে প্রতিপক্ষের সর্বনাশ করে দিত!
পরিসংখ্যানও এখন অন্ধ নয়, তাঁর ওয়ানডে সেঞ্চুরির শতকরা ৭৫ ভাগ ছিল ‘ম্যাচ উইনিং’। কিপিংয়ে তো নিজেকে সর্বকালের সেরাদের কাতারেই নিয়ে এসেছেন।
ওয়ানডেতে তিনি অপ্রতিরোধ্য, ডিসমিসাল সংখ্যা ৪৭২! যদিও এটা তাঁর কাছে ‘জাস্ট এ কাউন্টেড’ নাম্বার! টেস্টে ডিসমিসাল সংখ্যা ৪১৬, সামনে আছেন শুধু মার্ক বাউচার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি ডিসমিসালের রেকর্ড নিয়ে এই বাউচারের সাথেই হত প্রতিযোগিতা, একটা সময় গিলক্রিস্টই আগে চলে গিয়েছিলেন। গিলক্রিস্টের অবসরের পর বাউচার আবার যখন রেকর্ড নিজের করে নেন, তখন স্বয়ং বাউচারই এক গাল হেসে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস লোকটা অবসরে গেছে, এখন আমার এই রেকর্ডটা অনেকদিন টিকবে!’
তাঁর একটা বড়গুণ ছিল, তিনি তাঁর আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাই অন্যকে সম্মান দিতে কার্পণ্যবোধ করেননা।
অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী দলটার সবাই ছিলেন সুপারস্টার, লোকে বলে, সুপারস্টারদের একটু দুর্নাম না থাকলে মোটেও তাকে সুপারস্টার বলা চলেনা! তবে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সেইসময়কার অজিরা অনেকেই বেশ বড় মাপের সুপারস্টারসুলভ কর্মকাণ্ড করে বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছিলেন! কিন্তু সেই দলেই অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি তাঁর চরিত্রে কখনোই কালি লাগতে দেননি, বরং মহত্বই বাড়িয়ে গেছেন।
খেলা ছাড়ার পর বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িত করেছেন। ক্রিকেট নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন খুব সূক্ষ্ম ও সূদূরপ্রসারী। মোড়লদের মধ্যে সবমসময়ই বাংলাদেশের পক্ষপাতী ও বাংলাদেশে চরম সম্ভাবনা দেখা বিরলদের মধ্যে তিনি একজন।
প্রায় এক যুগের ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময়ে আম্পায়ার ডিসিশন দেওয়ার আগেই ড্রেসিংরুমে হাটা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন, কখনো বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান দেখিয়ে উদযাপন বন্ধ রেখেছেন। বাংলাদেশের হৃদয় ভাঙা ফতুল্লা টেস্টের সেঞ্চুরির পর তা ভুলে যাননি, বরং পরমযত্নে রেখে দিয়েছেন সেই ইনিংসে ব্যবহৃত ব্যাট, এ ইনিংসটি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এ ইনিংসটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা ইনিংস। খুব খারাপ অবস্থা থেকে আমি এগুচ্ছিলাম, কেউ জানতে চাইবে না আজ, কতটা লড়াই করে আমি সেদিন খেলেছিলাম, কারণ এ সেঞ্চুরি ছিল দুর্বল বাংলাদেশের বিপক্ষে। তাই হয়তো এটি সারাজীবন খেয়াল না করা এক মূল্যবান কীর্তি হিসেবেই রয়ে যাবে!’
কি অসাধারণভাবেই না কথা তুলে ধরেন তিনি!
অবসরের পর এখন পরিবারের সাথেই সময় কাটান, টিভিতে ধারাভাষ্যে নিয়মিত দেখা যায়। মাঝেমাঝে রিয়ালিটি শোতেও চলে আসেন, এ ব্যাপারে একটি মজার তথ্য না বলে পারছি না, আইপিএলের একটি অনুষ্ঠানে হিন্দী ভাষা না জানায় শাহরুখ খানের হাতে নাকাল হয়ে তিনি বিদ্রুপের শিকার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে শাহরুখকে জ্বালাতে ভোলেন নি তিনি, এজন্য মোটামুটি চালানোর মত হিন্দীও শিখেছিলেন তিনি!