দুই দশক আগে রিয়ালে মাদ্রিদে তারকার মেলা বসেছিল ডেভিড বেকহ্যাম, লুইস ফিগো, রোনালদো, রবার্তো কার্লোস এবং জিনেদিন জিদান সবাই একসাথে রিয়ালের জার্সি গায়ে খেলতেন একই সময়ে। কাগজে কলমে এটি ছিলো আমেজিং টিম।অপরদিকে রাইভাল বার্সা তখন দলে ভিড়িয়েছিলো এক আনকোরা খেলোয়াড় যার নামছিলো রোনালদিনহো।
তার সাথে ছয় মাসের জন্য ফ্রাংক রাইকার্ড লোনে ভেড়ান এডগার ডেভিডসকে। এই ডাচ ম্যান ভরসা রাখেন ইয়াং খেলোয়াড়দের উপর।লা মাসিয়া থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয় ইনিয়েস্তা এবং মেসিকে।
সালটা তখন ২০০৫। এল ক্লাসিকো বিশ্বের সবথেকে রোমাঞ্চকর রাইভালরিতে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনা। দ্বিতীয় স্থানে চ্যাম্পিয়ন বার্সা এবং মাত্র এক পয়েন্ট পিছিয়ে রিয়াল। ম্যাচটি যে কতোটা গুরুত্বপুর্ণ আশাকরি বোঝাই যাচ্ছে। মাদ্রিদে যেমন তারকার মেলা তারই সাথে বার্সায় ডেকো,ইতোদের মতো বিশ্বসেরারা।
বডি ফেইন্ট করে স্পেস তৈরি করে তারপর লফটেড এক পাস বাড়ালেন ইতোর দিকে। কিন্ত ইতো ঠিকমতো বল জালে জড়াতে ব্যর্থ। ম্যাচের ১৪ মিনিটে ওয়ান টু ওয়ান পাস ইতো আর মেসির মধ্যে। মেসি ১৮০ ডিগ্রি টার্ন করলেন তার বা পা দিয়ে।চারজন রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড় পরাস্ত করলেন।বল চলে গেলো ইতোর কাছে। ইতো সময়ের সেরা গোলকিপার ক্যাসিয়াস বাধা পেরিয়ে বল জলে জড়ালেন।
উদযাপনে, ইতো দৌড়ে পরিচালকের বাক্সে চলে গেলেন। যেখান থেকে একজন চিত্তাকর্ষক ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ বসে তার সাম্রাজ্য ভেঙে যেতে দেখছেন। ইতো তারপরে তার শার্টে বার্সা ব্যাজের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, শুধুমাত্র তিনি এখন যে বার্সেলোনার হয়ে খেলছেন তা জানানোর জন্য। দ্বিতীয়ার্ধে, নাম্বার টেন ছিল একটি ভিন্ন প্রাণী।
প্রথম হাফে ইতো, মেসিরা কয়েকবার চেষ্টা করলেও তাদের রুখে দেন ক্যাসিয়াস। ৫৭ মিনিটে রামোসকে পরাস্ত করে,তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান রোনালদিনহো। তারপর গুয়েরা,রবার্তো কর্লোসকে পরাস্ত করে, ইকার ক্যাসিয়াসকে বোকা বানিয়ে বল শেষমেশ জালে জড়ালেন রোনালদিনহো। ধারাভাষ্যকাররা বলে উঠলেন, ‘unstoppable, fantastic!’
ম্যাচের ৭৬ মিনিটে আবারো রামোসকে বোকা বানিয়ে, ইকার ক্যাসিয়াসকে পরাস্ত করে বল জালে জড়ালেন রোনালদিনহো। যেই রোনালদিনহোকে তার কুৎসিত চেহারার জন্য দলে ভেড়ায়নি পেরেজ সেই রোনালদিনহো একে একে তার সাম্রাজ্যকে গুড়িয়ে ভেঙে ফেললেন। বার্নাব্যুর রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকরাও দাড়িয়ে সম্মান জানালেন রোনালদিনহোকে। এর আগে রাইভাল সমর্থকদের কাছ থেকে এভাবে সম্মান পেয়েছিলেন কেবল ম্যারাডোনা। স্বয়ং বিপক্ষ দলের সমর্থকরাও রোনালদিনহোর জাদুতে মুগ্ধ হলেন।
সেই সিজনের ব্যালন ডি ওরও উঠলো এই রোনালদিনহোর হাতেই। কয়েকদিন পর ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ারও জিতে নিলেন এই দিনহো। দুইটা অ্যাওয়ার্ডই নিজের সতীর্থদের প্রতি উৎসর্গ করলেন তিনি।
সেই সিজনে রিয়াল মাদ্রিদের গ্যালাকটিকো টিমকে ১২ পয়েন্ট পিছিয়ে ফেলে লিগ শিরোপা জেতে বার্সেলোনা।জুলিয়ানো বেলেত্তির শেষ মুহূর্তের গোলে বার্সেলোনা সে বছর ইউরোপ সেরা ইউসিএলও জিতে নেয়। রোনালদিনহো প্যারিসে ট্রফি জিতলেও বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব অর্জন করেছিলেন এই কাতালুনিয়াতেই।
রোনালদিনহোর জাদুকরী মুহূর্তের দেখা পাওয়া যায় ব্রাজিলের জার্সি গায়ে অনূর্ধ্ব ১৭ দলে।জিওভান্নি, মাতুজালেম এবং জর্জিনহোকে নিয়ে গড়া সেই ব্রাজিল দলের স্টারবয় ছিলেন রোনালদিনহো। সিনিয়র ফুটবলে তার প্রথম পূর্ণ মৌসুমে ৪৮টি খেলায় ২৩টি গোল করার পর রোনালদিনহো তার অনূর্ধ্ব-১৭ দলের বন্ধু জিওভান্নির সাথে ব্রাজিলের সবচেয়ে লোভনীয় তারকা হয়ে ওঠেন।
২০০৬ বিশ্বকাপে রোনালদিনহো আদ্রিয়ানো, রোনালদো এবং কাকার পাশাপাশি আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের ব্রাজিলের বহুল প্রচারিত ‘ম্যাজিক কোয়ার্টেট’-এর অংশ ছিলেন। যাইহোক, ‘শীর্ষ ভারী এবং ভারসাম্যহীন’ হিসাবে বিবেচিত, দলটি পাঁচটি খেলায় দশটি গোলের সাথে শেষ করেছিল, রোনালদিনহো নিজে গোলহীন ছিলেন এবং শুধুমাত্র একটি এসিস্ট করেছিলেন।সেই টুর্নামেন্টে ব্রাজিল একটি হতাশাজনক অভিযান চালায় যা কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ১-০ ব্যবধানে হেরে শেষ হয়ে যায়, সেই সময় সেলেসাওদের গোলবারে মাত্র একটি শট ছিল।
এতটুকু পর্যন্ত রোনালদিনহোকে জাতীয় দলে অসফল মনে হলেও ২০০২ বিশ্বকাপে রোমারিওর জায়গায় ডাক পাওয়া দিনহো কিন্ত শুরুটা ভালোই করেছিলেন।চীনের বিপক্ষে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোল করলেন।তবে রোনালদো আর রিভালদোর ছায়াতেই যেনো রয়ে গেলেন।
তবে রোনালদিনহো ছিলেন স্পেশাল, আর স্পেশাল খেলোয়াড়রা স্পেশাল দিনেই নিজেকে প্রমাণ করেন।ইংল্যান্ড ছিলো সেবার বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট দল। ইংল্যান্ড দলে সেবার পল স্কোলস, ডেভিড বেকহাম, নিকি বাট, অ্যাশলে কোল, রিও ফার্ডিনান্দ কিংবা মাইকেল ওয়েনের মতো খেলোয়াড়েরা খেলছেন।কোয়ার্টার ফাইনালে সেই দলের মুখোমুখি হয় সেলেসাওরা।
খেলা শুরুর ২৩ মিনিটেই ওয়েনের গোল এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। ব্রাজিলের সমর্থকদের মনে সংশয় টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়ার। কিন্ত, রিভালদো প্রথম অর্ধের অন্তিম মুহূর্তে গোল দিয়ে সমতায় ফেরালেন সেলেসাওদের। রিভালদোর সেই গোলটার মূল কারিগর কিন্ত ছিলেন রোনালদিনহো। মাঝমাঠ থেকে এক নিখুঁত পাস দিয়েছিলেন তিনি রিভালদোর কাছে।
কিন্ত পুরো বিশ্বকে এখন রোনালদিনহোর জাদু দেখানোই যে বাকি। ম্যাচের ৫০ তম মিনিটে ৪০ গজ দূর থেকে ইংলিশ কিপার ডেভিড সিম্যানকে বোকা বানিয়ে টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা গোল করলেন এই ম্যাজিক ম্যান। সেই টুর্নামেন্টে ২ গোল,২ এসিস্ট তরুণ রোনালদিনহো নিজেকে তুলে ধরলেন বিশ্বকাপের মঞ্চেই।
নিজের ইনজুরি আর খামখেয়ালিপনা চেপে না ধরলে রোনালদিনহো আরো অনেক দূর যেতেই পারতেন।তবে ম্যাজিক ম্যান যতোটা পথ পাড়ি দিয়েছেন সেটিই বা কম কিসে।