৬০ বছরে কাঁধে দেশের দায়িত্বভার। তবুও মনটা যেন শিশুসুলভ, ফুটবলের প্রতি টানটা যেন রয়ে গেছে ঠিক সেই ছোট্ট বেলাটির মতো। তাইতো মাঠে নেমে গেলেন বার্ধক্য উপেক্ষা করে, পেশাগত ফুটবল খেলতে। বলছিলাম দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ সুরিনামের উপরাষ্ট্রপতি রুনি ব্রুন্সউইকের কথা।
৬০ বছর বয়স, উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই বয়সে এসেই অবসরে যাবার চিন্তা করেন। কিন্তু সূদুর দক্ষিণ আমেরিকার ক্যারিবিয়ান সমুদ্রতটে বসে সে বয়সে রুনি ব্রুন্সউইক হাল ধরেছেন তাঁর নিজ দেশের। পাশাপাশি উপমহাদেশের বৃদ্ধের মস্তিষ্ক জুড়েই যখন নির্জনে, কোন এক ছোট্ট পাড়া গাঁয় দিন পার করার মতো আলসেমি ঘোরাফেরা করে, তখন সুরিনামের উপরাষ্ট্রপতি মনে মনে ঠিক করলেন ফুটবল মাঠে শৈশবের স্মৃতিকে রোমন্থন করার কথা।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ভাবে দূর্বল দেশটার উপরাষ্ট্রপতি নেমে পড়লেন কনকাকাফ লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম লেগের ম্যাচ খেলতে। সুরিনামের ক্লাব ইন্টার মোয়েঙ্গোটাপোর হয়ে খেলতে নামেন ব্রুন্সউইক। হন্ডুরাসের দল অলিম্পিয়ার বিপক্ষে তাঁর ছেলে সমেত খেলতে নেমে ৬-০ গোলের বিশাল পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন সুরিনামের এই উপরাষ্ট্রপতি।
ইন্টার মোয়েঙ্গোটাপোর ক্লাবটির মালিকানাও তাঁর অধীনেই রয়েছে বলেই কিনা তিনি এমন খামখেয়ালি করতে পেরেছেন। ৫৩ মিনিট মাঠে ছিলেন বার্ধক্যের প্রথম প্রহরে থাকা এই রাজনীতিবিদ।
খেলোয়াড় ছাড়াও তার খেলা সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন সংগঠক। ২০০২ সাল থেকে ইন্টার মোয়েঙ্গোটাপোর তাঁর মালিকানাধীন এবং সভাপতিত্বও করছেন তিনি। দেশটির ময়েনগো নামক স্থানে নিজের নামে একটি স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠাও করেছেন ব্রুন্সউইক।
তবে আক্ষেপের বিষয় হল, দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে খেলতে পারছেন না তিনি। কেননা তার বিরুদ্ধে রয়েছে ইন্টারপোলের গ্রেফতারি পরোয়ানা। মাদক চোরকারবারির অভিযোগ রয়েছে রুনি ব্রুন্সউইকের বিরুদ্ধে। এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে গেরিলা বাহিনী গঠন ও তদারকির অভিযোগও রয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকটি ডাকাতির দায়ও তাঁর কাধেই। বোঝাই যাচ্ছে, বাইরের দুনিয়ায় তাঁর ভাবমূর্তিটা ঠিক সুবিধাজনক নয়।
বার্ধক্যে পেশাদার ফুটবল খেলার মতো স্বেচ্ছাচারিতার কারণ খুঁজতে ব্রুন্সউইকের রাজনৈতিক জীবনে একটু উঁকিঝুঁকি মারা গেলে খানিকটা আন্দাজ করা যেতে পারে। ষাটের দশকে সুরিনামের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমুল পরিবর্তনের মাঝেই জন্ম বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ রুনি ব্রুন্সউইকের৷ পরবর্তীতে আঠারো বছর বয়সে মিলিটারি ট্রেনিং শেষে সুরিনামের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডেসি বাউটারসের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দায়িত্ব পালন করেন ব্রুন্সউইক।
তাঁদের জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের চিন্তাভাবনা থেকে ১৯৮৫ সালের দিকে ব্রুন্সউইক তৈরি করেন ‘সুরিনামিজ লিবারেশন আর্মি’ নামক এক গেরিলা সংগঠন। যা জঙ্গল কমান্ডো’ হিসেবে বহুল পরিচিত ছিল। সামরিক বাহিনীর হাত থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সরকারি ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবার পাশাপাশি নিজেদের জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষায় ব্রুন্সউইকের নেতৃত্বে সংগ্রাম চালাতে থাকে জঙ্গল কমান্ডোরা। পরবর্তীতে তিনি সুরিনাম সেনাবাহিনীর বিপক্ষে করা গৃহযুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
১৯৮৬-৯২ পর্যন্ত এই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে ব্রুন্সউইক রাজনীতি অব্যহত রাখেন। দেশটির ‘জেনারেল লিবারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’-র চেয়ারম্যান পদে থেকেই তিনি উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০২০ এর জুনের এক নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি দেশটির উপরাষ্ট্রপতি পদে পদান্বিত হন৷
তাঁর কৈশর কেটেছিল গোলোযোগে, তারুণ্য তিনি পার করেছেন সংগ্রামে। জীবনের শেষ দিকটায় যখন ক্ষমতা তাঁর হাতে তখন স্বেচ্ছাচারিতায় মেটাতে চাইছেন ছেলে বেলায় পুশে রাখা পুরনো সেই ইচ্ছেটাকেই। হতে পারে পুরো ঘটনাটাই হাস্যরসাত্মক, কিন্তু তাতে কি এসে যায়? জীবন তো একটাই, সখ পূরণ করতে না পারার মত এক অপূর্ণতা নিয়ে পরপারে যাবার আগে নিন্দুকের মুখে ঝামা ঘষে দিতে পারাটা কিন্তু মন্দ নয়।