রয় ডায়াস: দৃষ্টিসুখের নি:সঙ্গ নাবিক

১৯৯৬ বিশ্বকাপ বদলে দিয়েছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট মানচিত্র। ভারত মহাসাগরের কোল ঘেঁষা দেশটি থেকে উঠে এসেছেন কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনাথ জয়াসুরিয়ার মতো ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু তাঁদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক কিংবদন্তি, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের সূচনা-লঙ্গে যিনি দলকে টেনেছেন একা হাতে। অসাধারণ সব কাভার ড্রাইভে মুগ্ধ করতেন দর্শকদের, সহজ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের উঠে আসার পথটা। তিনি রয় ডায়াস, লঙ্কান ব্যাটিংয়ের প্রবাদ পুরুষ। 

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শ্রীলংকার প্রথম টেস্টে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন রয় ডায়াস। কলম্বোতে বব উইলিসের সামনে যখন ধুঁকছে লঙ্কান ব্যাটিং লাইনআপ, তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব ডায়াসের। প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে ফিরলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৭ রান করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। বিশেষ করে কলম্বোর স্পিননির্ভর সেই পিচে ডেরেক আন্ডারউড এবং জন ওয়েরিকে যেভাবে সামলেছেন, তাতে বোঝার উপায় ছিল না প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছেন তিনি।

পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের সিরিজেই আরও উজ্জ্বল ডায়াস। সিদ্ধার্থ ওয়েট্টিমুনিকে সাথে নিয়ে ২১৭ রানের জুটি গড়ে দলকে এনে দিয়েছিলেন ১৮৪ রানের লিড। যে কোনো উইকেটে সেটাই ছিল টেস্টে শ্রীলঙ্কার প্রথম শতরানের জুটি। কিন্তু বোলারদের ব্যর্থতায় টেস্টে প্রথম জয়ের অপেক্ষাটা দীর্ঘায়িত হয় শ্রীলংকার। সেবার ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও তৃতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি তুলে নেন তিনি।    

টেস্ট অভিষেকের বেশ আগে থেকেই শ্রীলংকার ব্যাটিংয়ের মূল ভরসা ছিলেন তিনি। ১৯৭৯ সালে আইসিসি ট্রফিতে প্রায় ৭১ গড়ে সর্বোচ্চ ২১৪ রান করেন, তাঁর ব্যাটে ভর করেই প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা। শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে সিরিজে হাঁকিয়েছিলেন দুই সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ টেস্টের প্রতিটিতেই কমপক্ষে এক ইনিংসে ফিফটি ছাড়িয়েছেন ডায়াস। 

রয় ডায়াসকে ব্যাটিং করতে দেখা ছিল চোখের প্রশান্তি। দারুণ ফুটওয়ার্কে মনোমুগ্ধকর সব শট খেলে দর্শকদের যেন মায়াজালে আবদ্ধ করে রাখতেন। অফ সাইডে তাঁর ড্রাইভকে তুলনা করা হত জহির আব্বাস-দিলীপ ভেংসকারের মতো ব্যাটসম্যানদের সাথে। দুলীপ মেন্ডিসকে সাথে নিয়ে একাকী সৈনিকের মতো লড়াই করে পরবর্তী প্রজন্মের উঠে আসার পথটা নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি। 

রয়ের সবচেয়ে বিধ্বংসী রূপ দেখা যায় ১৯৮৫ সালে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে। কলম্বোতে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৯৫ এবং ৬০ রানের ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জয়ের মূল ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন তিনিই। ক্যান্ডিতে শেষ টেস্টেও দলের ত্রাণকর্তা তিনি।

২৪ রানে তিন উইকেট হারিয়ে লঙ্কানরা যখন ধুঁকছে, তখন ক্রিজে আগমন ডায়াসের। পরের পাঁচ ঘন্টা পুরোটাই ডায়াসময়, অপরপ্রান্তে আসা-যাওয়ার মিছিল চললেও একপ্রান্তে তিনি ছিলেন অবিচল। এতটাই সাবলীল ছিলেন যে সবাই ধরে নিয়েছিলেন সেদিন তাঁকে আউট করা কোনো বোলারের পক্ষে সম্ভব না।

আসলেই সম্ভব হয়নি, রান আউট হয়ে যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছেন ততক্ষণে লঙ্কানরা পেয়ে গিয়েছে সম্মানজনক সংগ্রহ। তাঁদের মোট সংগ্রহ ২১৭ আর ডায়াস একাই ১০৫। সেই টেস্টের পর প্রথম শ্রীলংকান ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম ১২ ইনিংসেই হাজার রানের কোটা পূর্ণ করেন তিনি। 

কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় এসে ফর্ম হারিয়ে ফেলেন। শেষ আট টেস্টে এক ফিফটিতে সংগ্রহ করেছিলেন মোটে ২৬৫ রান। তবে পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁকে মাপতে যাওয়া বৃথা। বেশিরভাগ সময়ে তাঁকে ব্যাট করতে হয়েছে পাহাড়সম চাপ নিয়ে, টেলএন্ডারদের নিয়ে। কেবল হাঁটতে শেখা শ্রীলঙ্কার তাঁর কাছাকাছি মানের ব্যাটারও ছিল না সে সময়ে।

ফলে একাকী নাবিকের মত হাল ধরতে হয়েছে তাঁকে। আজকের দিনে হয়তো অরবিন্দ ডি সিলভা কিংবা সাঙ্গাকারার ব্যাটিং দ্যুতিতে আমরা মুগ্ধ হই, হাততালি দিই। কিন্তু রয় ডায়াস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিশ্বমঞ্চে লংকান ব্যাটিংয়ের আভিজাত্য প্রথমবারের মত পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link