২০০১ মৌসুম শুরুর আগে দলবদলের প্রথম দিনে ক্লাব রেকর্ড ১৯ মিলিয়ন পাউন্ডে এক তরুণ ডাচ স্ট্রাইকারকে দলে ভেড়ান স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানইউ।
পিএসভির হয়ে আগের মৌসুমে আলো ছড়ালেও নিন্দুকেরা যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন গতিশীল প্রিমিয়ার লিগের সাথে তাল মেলাতে পারবেন কিনা, তাই নিয়ে। কিন্তু মৌসুম শেষের আগেই সব সন্দেহকে দূরে সরিয়ে দেন এই গোলমেশিন। বরং পরে মনে হয়েছে, এই ডাচ গোলমেশিনকে মুফতেই পেয়ে গেছে রেড ডেভিলরা।
প্রথম মৌসুমেই লিগের ৩২ ম্যাচে ২৩ গোল আর টানা আট ম্যাচে গোল করে অ্যালান শিয়েরার ও থিয়েরি অঁরিদের পাশে স্থান করে নেন। ম্যানইউ শিরোপা জিততে না পারলেও দর্শকদের মনে স্থান করে নেন এই স্ট্রাইকার। দুধর্ষ এই স্ট্রাইকারটি ছিলেন রুড ভন নিস্টলরয়।
১৯৭৬ সালে নেদারল্যান্ডসের উত্তর ব্রাব্রান্ট প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন এই স্ট্রাইকার। নিজের শহরের ক্লাব মারগ্রিটের যুবদলের হয়ে সেন্টার ডিফেন্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এই দীর্ঘদেহী ফুটবলার। এরপর তিনি ডাচ দ্বিতীয় বিভাগের দল এফসি ডেন বস-এ যোগ দেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে।
১৯৯৭ সালে ১৩ ম্যাচে ১২ গোল করলে তাকে স্ট্রাইকার হিসেবে দলে ভেড়ায় এসসি হেরেনভেন। সেখানে ৩১ ম্যাচে করেন ১৩ গোল। ১৯৯৮ মৌসুমে তার ২২ তম জন্মদিনে ৭ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তাকে দলে ভেড়ায় পিএসভি। সেটি তখন ছিল রেকর্ড ট্রান্সফার ফি যেকোন ডাচ ক্লাবের জন্য।
সেখানে তিন মৌসুমে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন তিনি, রীতিমতো গোলের বন্যা বইয়ে দেন। ৯৮ ম্যাচে ৭৪ গোলের পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করান ২৪ গোল। এ সময় প্রতি ১১০ মিনিটে একটি করে গোল করেন নিস্টরলয়। টানা দুই মৌসুমে পিএসভিকে ডাচ লিগের শিরোপা জেতানোর পর যোগ দেন ম্যানইউতে।
ম্যানইউতে যোগ দেবার পরও গোলের ধারা অব্যাহত রাখেন নিস্টলরয়। রেড ডেভিলদের হয়ে খেলাকালীন তিন মৌসুমে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। একমাত্র ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ছাড়া এই কৃতিত্ব নেই কারো। ২০০২-০৩ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের পাশাপাশি ২৫ গোল করে হন ইপিএলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। সে মৌসুমেই জেতেন নিজের ক্যারিয়ারের একমাত্র ইপিএল শিরোপা। রেড ডেভিলদের হয়ে ১৫০ ম্যাচে ৯৫ গোল করেন এই ডাচম্যান।
নিস্টলরয়ের ওল্ড ট্রাফোর্ড ছাড়ার কাহিনীটাও বর্ণিল। বেশ কয়েকটি ম্যাচে বেঞ্চে বসে থাকার পর স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও তাঁর স্বদেশি কার্লোস কুইরোজের (ম্যানইউর সহকারী কোচ) সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত সব মিলিয়ে ম্যানইউতে থাকাটা বেশ কঠিনই হয়ে উঠছিল তাঁর জন্য।
ম্যানইউতে ব্রাত্য হওয়া নিস্টলরয়কে ২০০৬ সালে কিনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। লা লিগায়ও শুরুতে সেই ঝলক। দ্বিতীয় ম্যাচে হ্যাটট্রিক, ২৫ গোল করে ‘পিচিচি’ ট্রফিটা এই ডাচম্যানের, আর লিগ শিরোপা রিয়ালের। পরের মৌসুমেও দেখান পায়ের ঝলক, হাঁটুর ইনজুরিতে কয়েকমাস মাঠের বাইরে থাকলেও ফিরে এসে ২৪ ম্যাচে করেন ১৬ গোল পাশাপাশি ৪ অ্যাসিস্ট।
রিয়ালও জিতে নেয় টানা দ্বিতীয় ঘরোয়া ডাবল। ১৯৯৮ সালে জার্মানির বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে কমলা জার্সিতে অভিষেক ঘটে নিস্টলরয়ের। ১৯৯৯ সালে মরক্কোর বিপক্ষে নিজের অভিষেক গোল পান তিনি, কিন্তু দল হেরে যায় ২-১ গোলে।
লিগামেন্টের ইনজুরির কারণে তিনি ২০০০ ইউরো খেলতে পারেননি। ২০০২ বিশ্বকাপে ডাচরা কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হলে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম বড় টুর্নামেন্টের অপেক্ষাটা বাড়ে নিস্টলরয়ের।
অবশেষে ২০০৪ ইউরোতে খেলার সুযোগ পান তিনি, সেখানেও শুরুতেই বাজিমাত। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচেই গোল করেন তিনি। যদিও সেমিফাইনালে পর্তুগালের কাছে হেরে যায় ডাচরা। ২০০৬ বিশ্বকাপে কোচ মার্কো ভন বাস্তেনের সাথে ব্যক্তিগত সংঘাতের কারণে খুব বেশি মাঠে নামার সুযোগ পাননি। ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে ডাচরা। জাতীয় দলের হয়ে ৭০ ম্যাচে ৩৫ গোল করেন এই স্ট্রাইকার।
হতে পারতেন সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন, কিন্তু ডান হাঁটুর লিগামেন্টের ইনজুরিটা ভুগিয়েছে পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই। ২০০৮ সালে জন্মদিনের এক দিন আগে পুনরায় হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে পুরো মৌসুমের জন্য দল থেকে ছিটকে পড়েন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ৬৮ ম্যাচে করেন ৪৬ গোল।
২০১০ সালে যোগ দেন জার্মান ক্লাব হামবুর্গে। কিন্তু সেখানেও পিছু ছাড়েনি ইনজুরি, ফলশ্রুতিতে খেলতে পারেননি ২০১০ বিশ্বকাপও। অবশেষে ইনজুরির কাছে পরাজিত হয়ে ২০১২ সালে ৩৫ বছর বয়সে সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।
একজন পারফেক্ট স্ট্রাইকারের মাঝে যেসব গুণাবলি থাকা প্রয়োজন সবই বিদ্যমান ছিল তার মাঝে; দুই পায়েই সমান সক্ষমতা, হেডে পটু, দারুণ পজিশনিং সেন্স, জোরালো শট নেবার ক্ষমতা সবমিলিয়ে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ এক স্ট্রাইকার। কিন্তু ইনজুরির কারণে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারলেন না।
খেলা ছাড়ার পর যুক্ত হয়েছেন ফুটবল কোচিংয়ের সঙ্গে। বর্তমানে নেদারল্যান্ডস ফুটবল দলের সহকারী কোচ তিনি। সম্প্রতি প্রধান কোচ ফ্রাঙ্ক ডি বোর বরখাস্ত হবার পর ধারণা করা হচ্ছে তিনিই হবেন পরবর্তী কোচ। তার অধীনে ফুটবলের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে ডাচরা সেই প্রত্যাশায় দিন কাটছে ফুটবল ভক্তদের।