পরিবারের সবার ছোট শচীন। তাঁর মধ্যবিত্ত বাবা-মা দুজনেই চাকরি করতেন। তাই শচীন বড় হয়েছেন বাড়ির কাজের সহায়িকার কাছে। তার নাম লক্ষ্মী। শচীনের বয়স ১২ বছর হওয়া পর্যন্ত শচীন লক্ষ্মীর কোলে-পিঠেই মানুষ। শচীন মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে কখনোই কার্পন্য করেননি।
লক্ষ্মী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ও যখন বিয়ে করলো, আমার জন্যে আলাদা করে গাড়ি পাঠিয়েছিলো বিয়েতে যাবার জন্যে। বিয়েতে শচীন নিজের হাতে আমাকে খাবার দিয়েছে, প্রথম গ্রাসটাও ওই আমাকে খাইয়ে দিয়েছিলো। পরেও যেখানেই আমার সাথে দেখা হয়েছে, ও গাড়ি থেকে নেমে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছে। শচীন একেবারে ওর বাবার মতো, একদম দেবতূল্য মানুষ।’ ভাবা যায় ব্যাপারটা?
শচীনের খেলোয়াড় হিসেবে চিন্তাভাবনা ছিলো একেবারেই আলাদা ধরণের। অন্য খেলোয়াড়েরা যখন গ্রাউন্ডসম্যানদের সাথে তেমন একটা মেশেনই না, সেখানে শচীন হচ্ছেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গ্রাউন্ডসম্যানদের সাথে তার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিলো সবসময়ই, বিশেষ করে মুম্বাই এর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ডসম্যানদের সাথে।
শচীনের মতে গ্রাউন্ডসম্যানরা হচ্ছেন ক্রিকেটের আনসাং হিরো। ২০১২-২০১৪ সালে শচীন গোটা বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে তার সমস্ত উপার্জন ওয়াঙ্গখেড়ে স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ডসম্যানদের উপহার দিয়েছিলেন। অবসরে যাবার সময়েও করেছিলেন একই কাজ। সব গ্রাউন্ডসম্যানদের টাকায় ভরা একটা করে খাম পৌঁছে দিয়েছিলেন নিজে। উপহার।
ভারতের প্রাক্তন ফাষ্ট বোলার রাজু কুলকার্নি ছিলেন শচীনের ঘরোয়া ক্রিকেটের একদম শুরুর দিকে সহখেলোয়াড়। একই দলে খেলতেন দুজন। একটা সময়ে রাজু কুলকার্নি ক্রিকেট থেকে সরে গেলেও শচীন রাজু কুলকার্নির সাথে যোগাযোগ ঠিকই রেখেছিলেন। শচীন জানতেন রাজুর ১০ বছরের ছেলে গাড়ির ভীষণ ভক্ত।
শচীন যখন প্রথম ফেরারি কেনেন, রাজুর ছেলেকে কথা দিয়েছিলেন গাড়িতে প্রথম রাজুর ছেলেকেই নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। যখন গাড়ী ডেলিভারি দেয়া হয় তখন শচীন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরছেন। রাত একটায় মুম্বাই নামার কথা ছিলো শচীনের, কিন্তু দেখা গেলো ফ্লাইট ম্যালা দেরী করে ফেলেছে।
একে তো দীর্ঘ যাত্রা তার উপর ফ্লাইট দেরী, রাজু তার ছেলেকে ঘুমুতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ অতো ঝক্কি ঝামেলা করে শচীনের এয়ারপোর্টে নেমে রাজুর বাড়িতে যাবার কথা না। বিশ্রামের দরকার তো আছে। কিন্তু শচীন তো শচীন, দেখা গেলো শচীন ভোর চারটার সময় ফেরারি নিয়ে রাজুর বাড়িতে হাজির। নিজের ফেরারিতে রাজুর ছেলেকে বসিয়ে সেই ভোর চারটায় গোটা মুম্বাই দাবড়ে বেড়ালেন।
শুধুমাত্র এই এক ভদ্রলোকের কারণে ৯০ দশকের ছেলেপিলেরা বিশ্বাস করতো এমআরএফ নামে ব্যাট আছে, ওটা অন্য কোন কোম্পানি না। এই এমআরএফ স্টিকার লাগিয়ে কতো যা-তা ব্যাট বিক্রি হয়েছে, আমরা কিনেছি, তার ইয়ত্তা নেই। শচীনের কোম্পানির ব্যাট বলে কথা! ভাবই আলাদা! পরে একটা সময় সবাই বুঝেছে, ও আসলে স্টিকার, ব্যাটের নাম না, টায়ার কোম্পানির নাম এমআরএফ।
এসব শুনলে শচীন কে কেমন নিজেদের মানুষ মনে হয়না? মনে হয়না, যে ভারতবর্ষে এতো ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের হিসেব, সেই মানুষটা সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে কী করে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিলেন? কী সেই আশ্চর্য্য যাদুকরী ক্ষমতা? সম্ভবত এই ‘ডাউন টু আর্থ’ মানসিকতা।
খেলার মাঠে মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন কিংবা নখ, একটু পর পর হাতের ব্রেসলেট টা হাত ঝাঁকিয়ে উপরে তুলে নিচ্ছেন। ব্যাটিং এ নামলে চুপচাপ একবার আকাশের দিকে তাকিয়েই মাথা নীচু করে ক্রিজে যাওয়া থেকে শুরু করে হঠাত করেই তীব্র পাশবিক আগ্রাসনে প্রতিপক্ষের দানবীয় বোলারদের ছিঁড়েখুড়ে ফেলা! কেমন যেন খাপ খায়না শচীনের ক্রিজের বাইরের চেহারাটার সাথে, তাও এরকমই হয়েছে।
ভারতীয় ক্রিকেটে ঈশ্বরের মর্যাদা পেয়েও মাটিতেই থাকাটাই, পা মাটিতে রাখাটাই হয়তো শচীনকে নিয়ে গেছে হিমালয়সম উচ্চতায়।
মুগ্ধ বাঙালি কবি লেখেন,
হিমালয় থেকে কণ্যাকুমারী,
পাঞ্জাব থেকে কোচিন,
এক নামেতে চিনবে সবাই,
টেন্ডুলকার শচীন।
স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষ সব ভুলে তীব্র গর্জনে আশপাশ কাঁপিয়ে দেয়। সেই গর্জন যায় সাগর ছাপিয়ে, শ…চীন, শচীন…শ…চীন শচীন…।