এটা অনেকেই মনে করেন যে শচীন টেন্ডুলকার চতুর্থ ইনিংসে অধিকাংশ চাপের মুহুর্তে ব্যর্থ হয়েছিলেন যার ফলে ভারতের অনেক ম্যাচে হারের মুখ দেখতে হয়েছিল; তুলনামূলক ভাবে অন্যেরা এই ধরনের সংকটজনক পরিস্থিতিতে অনেক ভালো পারফর্ম করেছিলেন।
তবে, জানতে পারলাম এই দাবিটি বাস্তবে ভুল এবং চেরি পিকিং ফ্যালাসি নামক একটি পরিসংখ্যানগত বিভ্রমের ফল। আমি মূল লেখাটির বক্তব্য নিজের মতো করে লেখার চেষ্টা করছি।
- কিংস্টন ২০০২
এই টেস্টটি ছিল সিরিজের নির্ণায়ক লড়াই, তখন অবধি উভয় দলই একটি করে টেস্ট জিতেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংসে ২১০ রানের লিড পায়। অধিনায়ক কার্ল হুপার ফলোঅন করাননি এবং জয়ের জন্য ভারতকে ৪০৮ রানের প্রায় অসম্ভব টার্গেট দেন।
চতুর্থ বিকেলে চায়ের সময়, ভারতের তখনও ২৪২ রান দরকার ছিল এবং টপ অর্ডারের তিনজন ব্যাটসম্যানকে হারিয়েছিল। তবে দল ও সমর্থকদের একমাত্র আশা শচীন তখনও ছিলেন। শচীন টেন্ডুলকার ৩৫ বছর বাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভারতের প্রথম জয়ে পোর্ট অফ স্পেনে ইতিমধ্যে ১১৭ রান করেছিলেন।
কিন্তু তারপর, হঠাৎ করেই মনে হচ্ছিল সিরিজের মাঝামাঝি সময় থেকে ফর্ম হারিয়ে বাঁহাতি পেসার পেড্রো কলিন্সের কোনাকুনি ডেলিভারির কাছে বারবার পরাস্ত হচ্ছিলেন তিনি। এই ইনিংসে অবশ্য দারুন টাইমিং করছিলেন মাস্টার। দুই উইকেটে ২৫ রানের পরিচিত পরিস্থিতিতে নেমে তিনি জয়ের লক্ষ্যেই স্ট্রোক খেলছিলেন।
রাহুল দ্রাবিড় দলের ৭৭ রানের মাথায় ৩০ রান করে আউট হন, কিন্তু অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি নিখুঁত খেলছিলেন। টেন্ডুলকারের ব্যাট থেকে বাউন্ডারি আসছিলো এবং চা বিরতির সময় তিনি ৮২ রানে নট আউট ছিলেন।
কলিন্স যখন চা বিরতির পর প্রথম ওভার শুরু করেন, টেন্ডুলকার অনেকটা ক্যারিবিয়ান স্টাইলে একটি দুরন্ত কভার ড্রাইভ মারেন। এবং তারপর, ওভারের শেষ বলে, ঘটে যায় ট্র্যাজেডি! ভারতীয় সমর্থকদের জন্যে হৃদয়বিদারক ঘটনা। বলটি প্রত্যাশার চেয়ে কম বাউন্স খেয়ে সচিনের স্টাম্পে আঘাত করে। টেন্ডুলকার দুর্দান্ত ৮৬ রানে ফিরে যান এবং ভারতের রান দাঁড়ায় চার উইকেটে ১৭০ রান।
শচীনের উইকেটের সাথে সাথে সৌরভের মুখের এক্সপ্রেশন গোটা গল্পটা পরিষ্কার করে দেয়। সিরিজ জয়ের ন্যূনতম কোনো আশা থাকলেও সেটা ভেঙ্গে পড়ে এবং অধিনায়কের মুখের হতাশার অভিব্যক্তিতে সেটা প্রকাশ পায়। ভিভিএস লক্ষ্মণ তখনও নামেননি, কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ভারতের ম্যাচ জেতার সবচেয়ে বড় আশা প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ভারত ১৫৫ রানে টেস্টটা হারে, গাঙ্গুলি ২৮, লক্ষ্মণ ২৩ রানে আউট হন।
টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ের জন্য, এটি ছিল ভারতীয় দলের চিরপরিচিত গল্প। যতক্ষণ তিনি উইকেটে আছেন ততক্ষণ আশা এবং তার বিদায়ে সবকিছু ভেঙে পড়া। ১৯৯৯ সালে চেন্নাইয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইনিংসটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যখন ২৭০ রান তাড়া করে সচিন নেমেছিলেন ভারত যখন ৬/২; টেন্ডুলকারের ১৩৬ রানে ২৫৪ পর্যন্ত পৌঁছেছিল ভারত এবং যখন তিনি চলে যাবার পর ভারত আর মাত্র চারটি রান করতে পেরেছিল।
যাই হোক, লোকটির উপর তার দলের অনস্বীকার্য নির্ভরতা সত্ত্বেও, এটা একটা বহুলপ্রচলিত ধারণা, এবং তার সমালোচকদের দৃঢ় বিশ্বাস যে তিনি চতুর্থ ইনিংসে পারফর্ম করেননি যখন দল সবচেয়ে বিপদে, অর্থাৎ সংকটময় মুহূর্তে তিনি বরাবর ব্যর্থ হন।
এর পর আরেকটু এগোলে যেটা দাঁড়ায়, লোকেরা বিশ্বাস করে যে লক্ষ্মণ বা রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ব্যাটসম্যানরা চতুর্থ ইনিংসের সংকটজনক পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক বেশি কার্যকর ছিলেন। সর্বোপরি, চতুর্থ ইনিংসে টেন্ডুলকারের আউট হওয়ার এবং ভারতের টেস্ট হারের অনেক স্মৃতি রয়েছে, যে ম্যাচগুলো হয়তো বাঁচানো যেত বা জেতা যেত।
অন্যদিকে, আমাদের মনে আছে লক্ষ্মণ ভারতকে মোহালিতে অস্ট্রেলিয়ানদের বিরুদ্ধে সেই অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েছিলেন – সেই ৭৩* এর ইনিংস যা ভারতকে এক উইকেটে জিতিয়েছিলো রুদ্ধশ্বাস শেষ কিছু মিনিটের পর। দ্রাবিড়? তিনি অপরাজিত ৭২ রান করেছিলেন যখন ভারত অ্যাডিলেডে জিতেছিল (২০০৩)।
একজন ক্রিকেটপ্রেমী সম্প্রতি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমার দ্রাবিড়ের এমন চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচ জেতানো অন্য কোনও ইনিংস সত্যিই মনে পড়ছে না, নিশ্চই আরো বেশ কিছু ইনিংস আছে। ভুলে গেলে চলবে না, তিনি ছিলেন – দ্য ওয়াল।’
‘অবশ্যই, জীবন বাজি রেখে ব্যাট করার জন্য আমরা কখনই টেন্ডুলকারের উপর নির্ভর করব না যিনি চাপের পরিস্থিতি খুব কমই সামলাতে পারেন। আমাদের দ্রাবিড়ের মতো লোকের প্রয়োজন হবে, বা এমন লোক যাকে সবসময় প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করার জন্য বিশ্বাস করা যেতে পারে’ – স্টিভ ওয়াহ।
- নীরস সংখ্যাতত্ব
সুতরাং, প্রথমে দেখে নেওয়া যাক গত কয়েক দশকে ভারত যে টেস্ট ম্যাচগুলি হেরেছে তার চতুর্থ ইনিংসে কে কেমন করেছেন? এবং আসুন জেনে নেওয়া যাক টেন্ডুলকার তার সমসাময়িকদের তুলনায় কেমন পারফর্ম করেছেন।
টেন্ডুলকার এমন ২৬টি টেস্ট খেলেছেন যেখানে ভারত চতুর্থ ইনিংস ব্যাট করে হেরেছে, এই ইনিংসগুলোতে সচিন ২৩.০০ গড়ে একটি সেঞ্চুরি এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৯৮ রান করেছেন। দ্রাবিড় এরকম ২৩টি চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করেছেন, ২১.৩১ গড়ে ৪৬৯ রান করেছেন, কোন সেঞ্চুরি নেই, দুটি অর্ধশতক।
লক্ষ্মণ, এমন ২০টি পরিস্থিতিতে, তিনটি অর্ধশতকের সাথে ২২.৩১ এ ৪২৪ রান শেষ করেছেন। আমরা যদি তাদের যুগের অন্য মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের হিসেবের মধ্যে নিয়ে আসি, গাঙ্গুলি এই ধরনের ১৭টি টেস্টে, ২০.৫২ গড়ে একটি ফিফটি সহ ৩৪৯ রান করেছেন।
প্রথম চমক হল এই ধরনের পরিস্থিতিতেও আবার টেন্ডুলকারই টেবিলে সবার উপরে। লক্ষ্মণ আসলে সচিনের ঠিক পরেই নন। চতুর্থ ইনিংসে হেরে যাওয়া ম্যাচে টেন্ডুলকারের পরে দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন বীরেন্দ্র সেহওয়াগ, আরেকটি অপ্রত্যাশিত নাম। হেরে যাওয়া টেস্ট ম্যাচের নয়টি চতুর্থ ইনিংসে তার ২০৪ রান এবং দুটি অর্ধশতকের সাহায্যে গড় ২২.৬৬।
যদি আমরা মনে করি যে ৫০ এর কম স্কোর = একটি ব্যর্থতা, সেক্ষেত্রে হারের ম্যাচগুলোতে কে কতবার ৫০ এর কম করেছেন দেখা যাক। টেন্ডুলকারের ২৬ টি টেস্টের ২২ টিতে ৫০ এর কম করেছেন। দ্রাবিড়ের জন্য, এটি ২৩-এর মধ্যে ২১, লক্ষ্মণ ২০-এর মধ্যে ১৭, গাঙ্গুলী ১৭-এর মধ্যে ১৬।
তথ্য থেকে উপসংহার হল যে, টেন্ডুলকারের চতুর্থ ইনিংসের ব্যর্থতা লক্ষ্মণের সমান, এবং দ্রাবিড় এবং গাঙ্গুলীর তুলনায় কম ঘন ঘন। অবশ্যই, এই ইনিংসগুলির ওভারল্যাপ আছে যেখানে বেশিরভাগ বা চারজনেই একসাথে ব্যর্থ হয়েছেন।
- চেরি পিকিং ফ্যালাসি
তবুও, আমরা মনে করি টেন্ডুলকার এমন পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করতে গিয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছেন যা ভারতকে পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে বহুবার। কেন? উত্তরটি আমরা যেভাবে প্রশ্নের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি তার মধ্যে রয়েছে।
আমরা প্রায় স্থির বিশ্বাস নিয়ে এগিয়েছি যে টেন্ডুলকার সত্যিই চতুর্থ ইনিংসে ব্যর্থ। এই অনুমানকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি বা এমন উদাহরণগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি যা দেখায় যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি সত্যিই ব্যর্থ হয়েছেন। যে
হেতু তিনি মিডিয়াতে, ক্রিকেটবিশ্বেরও সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত খেলোয়াড়, এই ধরনের উদাহরণগুলি সহজেই মনে করা থেকে গেছে মানুষের এবং খুব সহজেই হাতের কাছে উদাহরণগুলো পাওয়াও যায়। এবং আমরা সাধারণত ইগনোর করি সেই ম্যাচগুলো যেখানে তিনি ব্যর্থ হননি।
একে বলা হয় ‘চেরি পিকিং ফ্যালাসি’ — যেখানে আমরা প্রাক-কল্পিত সমাধানের দিকে নির্দেশ করে ডেটার পৃথক অংশগুলোকে দেখি (snapshot) বাকি প্রমাণগুলিকে উপেক্ষা করে, যেগুলো হিসেবের মধ্যে আনলে দেখা যাবে বাস্তবটা কিছুটা আলাদা। এটা হলো পক্ষপাতের সবচেয়ে প্রচলিত উদাহরণ যা আমরা বিশ্বের সর্বত্র খুঁজে পাই।
এটিই আমাদের ভাবতে শেখায় যে যে যারা বেশি জনপ্রিয় তারাই প্রকৃত বড়ো শিল্পী। আমরা খবরের কাগজ বা মিডিয়ায় যা যা পড়ি তার দ্বারা প্রভাবিত হই এবং আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরের অনেকগুলি উদাহরণকে উপেক্ষা করি যারা হয়তো অনেক বেশি প্রতিভাবান কিন্তু সুযোগ পাচ্ছেন না। সেই কারণেই ‘সেভেন হ্যাবিটস অফ হাইলি এফেক্টিভ পিপল’-এর মতো বই বেস্টসেলার হয়ে ওঠে, কিন্তু কারুর মনে এই প্রশ্নটা আসেনা যে এই একই ৭ টা অভ্যাস আরো অনেকের থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কেন বিখ্যাত হতে পারেননি?
আমরা আমাদের চিন্তাধারার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে চেরি-পিকিং চালাতে থাকি অবচেতনে। দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ এবং বাকিদের জন্য, আমরা টেন্ডুলকারের মতো ব্যর্থতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি না। আমরা বিপরীত উদাহরণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করি – যেখানে তারা চতুর্থ ইনিংসে সফল হয়েছেন। তাই আমরা ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হই।
একইভাবে, সফল চতুর্থ ইনিংস তাড়া করার সময়, আমরা খুব কম সময়েই এটা মনে রাখি যে লক্ষ্মণের সাথে টেন্ডুলকারই একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান যিনি অপরাজিত সেঞ্চুরির মাধ্যমে ভারতকে চতুর্থ ইনিংসে জয়ের পথে দেখিয়েছেন; আমরা ভুলে যাই যে টেন্ডুলকার জয়ী ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ৫৯.৫৮ গড়ে ৭১৫ রান সহ ২২ ইনিংসে একটি সেঞ্চুরি এবং চারটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন এবং ভারতীয়দের মধ্যে এই বিভাগে তিনিই সর্বোচ্চ স্কোরার। এগুলি আমাদের মজ্জাগত বিশ্বাসের জন্য ‘খারাপ চেরি’ এবং আমরা সাধারণত সেগুলি এড়িয়ে চলি, ‘পিক’ করি না।
ঠিক আছে, যদি আপনি এখনও কারুর জীবন বাজি রেখে ব্যাটিং করার জন্য প্রথম পছন্দ যিনি তাঁর কথা ভাবেন, তাঁর পরিসংখ্যান ও দেওয়া হলো – স্টিভ ওয়াহ ১৩টি ম্যাচ খেলেছেন যেখানে তিনি চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করেছেন এবং অস্ট্রেলিয়া হেরেছে। তিনি এই ইনিংসগুলিতে ১৫.৪৫ গড়ে ১৭০ রান করেন, সর্বোচ্চ ৩০ অপরাজিত।
স্টিভ ওয়াহর কাছ থেকে হারের মুখে কোন ফিফটি নেই! যাঁর সম্পর্কে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে সঙ্কট পরিস্থিতিতে স্টিভ সর্বদা সফল হতেন। স্টিভের পুরো ক্যারিয়ারে ব্যাট করা ৩১ টি চতুর্থ ইনিংসে তিনি মাত্র দুটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন এবং গড় ২৫.৫৪।
অতএব, পার্সেপশন এর উপর ভিত্তি করে চেরি পিকিং করে পরিসংখ্যান দেখা কিন্তু বেশ ভালোরকম বিভ্রান্তিকর হতে পারে!