শচীনের সেঞ্চুরিয়ান মহাকাব্য

ভারত পাকিস্তান এমনিতে বিশ্বকাপে দেখা হলে শেষ হাসি বরাবর ভারতই হেসেছে, কিন্তু সে বারে পাকিস্তান খোঁচা খাওয়া বাঘ, দুর্ধর্ষ বোলিং লাইন আপ নিয়ে এবারে প্রতিশোধ নেবেই এরকম একটা ভাব ওয়াকারদের শিবির থেকে ভেসে আসছিলো, সঙ্গে দু’সপ্তাহ আগে ভারতের ‘সেঞ্চুরিয়ন ম্যাসাকার’ মাথায় রেখেছিল পাক শিবির।

আর ম্যাচ শুরু হতেই বোঝা গেল আজ সহজে ছাড়বেন না আনোয়াররা। ভারতের যে পেস আক্রমণ গত তিন ম্যাচের বিপক্ষের সামনে ত্রাস হয়ে দাঁড়াচ্ছিল তাদের একদম সাধারণের পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন আনোয়ার, ইয়োহানারা (এখনকার মোহাম্মদ ইউসুফ)। সাঈদ আনোয়ার ভারতকে দেখলে বরাবরই অন্য গ্রহের ব্যাটসম্যান হয়ে যান, এদিনও তাই হলেন।

শ্রীনাথ, জাহির, নেহরাদের যথেচ্ছ কাট-পুল-ড্রাইভে দিশেহারা করে দিচ্ছিলেন। হরভজনের জায়গায় সৌরভ এদিন কুম্বলেকে খেলান, আনোয়ার দের বিরুদ্ধে তাঁর দারুন রেকর্ডের কথা মাথায় রেখে, সেই কুম্বলেও ১০ ওভারে ৫১ দিলেন, ওদিকে আনোয়ার ও তাঁর ক্যারিয়ারের ২০ তম শতরান আর ভারতের বিরুদ্ধে ২০০০ রান পূর্ণ করে ফেললেন। এর মাঝে ইনজামাম আবারো তাঁর অ‘প্রিয়তম’ রানআউট হয়েছেন ওয়ান ডে ক্রিকেটে ৩৫তম বারের মতো।

শেষ দিকে ইউনুস খান, রশিদ লতিফ, আক্রমরা চালিয়ে খেলে পাকিস্তানকে ২৭৩ দিয়ে দিলেন। ভারতীয় বোলাররা সেঞ্চুরিয়নের পিচের সাথে অ্যাডজাস্ট করতে না পেরে যথেচ্ছ ওয়াইড করলেন,সাবেকি চিত্রনাট্যে ভারতের হারার দিন, ঢাকার স্বাধীনতা কাপ ফাইনাল বাদ দিলে কস্মিনকালেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এত রান তাড়া করে জেতেনি ভারত।

কিন্তু এক মার্চ ২০০৩, মনে হয় ক্রিকেট দেবতার পাশা উল্টে দেওয়ার দিন। নাহলে সচিন আর বীরু যেভাবে ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব নিয়ে প্রথম বল থেকেই চড়াও হলেন দেখে তো তাই মনে হবার কথা। আর বিপক্ষে বোলিং লাইন আপে কারা? না, আফ্রিকার সিংহের মতো তেজে তাকিয়ে থাকা আক্রম, শোয়েব, ওয়াকার ইউনিসরা। প্রথম ওভারেই আক্রমকে এমন একটা ব্যাকফুট পাঞ্চ মেরে বলটাকে বাউন্ডারি পার করলেন শচীন, সেটা যেন গোটা ইনিংসের এক প্রতীকী হয়ে গেল।

যে প্রান্তে যে আসছেন বল হাতে তার ওপরই চড়াও হচ্ছিলেন তিনি, ব্যাটে তখন যেন ‘ডনের জাদু’। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের ওপর দিয়ে শোয়েবকে যে ছক্কাটা মারলেন এরপরে আর শোয়েবের হাতে কিছুক্ষন বল তুলে দিতে ভরসা পাননি পাক অধিনায়ক ওয়াকার, নিজে বল তুলে নিয়ে মারমুখী শেবাগকে ফেরত পাঠালেন, সৌরভকেও তাঁর শিকার বানালেন।

লেগস্ট্যাম্পের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া বলটায় কেন যে আম্পায়ার কোর্টজেন আঙুল তুললেন, তা তিনিই জানেন, পরিস্কার ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হলেন সৌরভ। এর মধ্যে শচীন যখন ৩২ রানে ব্যাট করছেন আকরাম, আব্দুল রাজ্জাককে মিডঅফে একটু এগিয়ে থাকতে বললেও কোনো অজ্ঞাত কারণে ৫০০ উইকেটের মালিকের কথায় কর্ণপাত করলেন না রাজ্জাক।

আর শচীনকে ক্যাচ তোলাতে বাধ্য করলেন আকরাম, কিন্তু ওই যে ক্রিকেট দেবতা যদি মুম্বাইবাসীর ব্যাটে ভর করেন তাহলে সেদিন কারোর কিছু করার থাকে না, তাই ক্যাচ ও পড়লো রাজ্জাকের হাত থেকে আর ম্যাচ থেকে হারাতে শুরু করছিলো পাকিস্তান। সৌরভ আর শেবাগ আউট হলেও অপরপ্রান্তে কাইফকে সঙ্গী করে ধ্বংসলীলায় তখন মেতেছেন শচীন। মনে হচ্ছে যুদ্ধ ক্ষেত্র তিনি একাই রাজ করতে এসেছেন, সেই যুদ্ধে অক্ষত্রিয় পন্থায় এক আধটা বল ছোঁড়া শুরু করেছেন তখন অপর প্রান্তে রক্তাক্ত সৈনিক শোয়েবও।

তেমনই এক খানা বল অতর্কিতে লাফিয়ে শচীনের গ্লাভস ছুঁয়ে ইউনুস খানের তালুবন্দি যখন হলো, অমর ইনিংসের শতরান পূর্ণ হতে আর মাত্র দুইরান বাকি ছিল। গোটা সেঞ্চুরিয়নকে স্তব্ধ করে আক্রম, শোয়েবদের গোলাবারুদ সামলে টেন্ডুলকার নামক বীর সৈনিক যখন বেরিয়ে আসছেন তখন তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ৭৫ বলে ৯৮।
আফ্রিকার মাটিতে খেলা সর্বকালের অন্যতম সেরা ওয়ান ডে ইনিংসটা যখন শেষ হলো ভারতের জিততে তখনো প্রায় শ’খানেক রান বাকি, রক্তের গন্ধ পেয়ে তখন আবার ফুঁসছেন ওয়াকার, শোয়েবরা।

আর একটা উইকেট চলে গেলেই ম্যাচ পাক শিবিরের দিকে ঢলে পড়বে, এ হেন অবস্থায় দ্রাবিড় – যুবরাজ তাঁদের যাবতীয় ঢাল তরোয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে সেঞ্চুরিয়নের পড়ন্ত বেলায় এটা একটা ক্রিকেট ম্যাচ নয়, হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্য বাঁচানোর লক্ষ্যে দুই পরাক্রমশালী দেশের এক যুদ্ধের ময়দান। ওয়াঘার ওপারের শোয়েব যদি গোলাগুলি বর্ষণ করেন এপারের পাঞ্জাবপুত্তর যুবরাজও কম যান না, সেই গোলাকে মাঠের বাইরে পাঠানোর ক্ষেত্রে।

চূড়ান্ত নার্ভের সেই পরীক্ষায় ৪৫.৪ ওভারের মাথায় দেখা গেল সসম্মানে উত্তীর্ণ সেই ভারতই। টানা চারবার বিশ্বকাপে পাকবধ সম্পন্ন হলো শেষ পর্যন্ত যুবরাজের এক অমূল্য ৫০ আর দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা মেনে ৭৬ বলে ৪৪ নট আউটে। লাহোর, করাচি, ইসলামাবাদে যখন ঘরে ঘরে পাকিস্তান হারার পর টিভি ভাঙার পালা শুরু হবে হবে করছে, গোটা ভারতে তখন যেন অকাল দীপাবলী।

শচীনের ম্যাচের সেরা হওয়াটা তখন যেন নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা, সৌরভের টিম ইন্ডিয়া ততক্ষণে পাকিস্তানের বিদায় ঘটিয়ে শচীন রথে চড়ে সুপার সিক্সের হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এটাই তখন দস্তুর। যে দলটা এক মাস আগে দক্ষিণ আফ্রিকা এসেছিলো নিউজিল্যান্ড বিপর্যয়ের কালিমা নিয়ে, বিশ্বকাপে এসেও একের পর এক বাঁধা, আবার বিপর্যয়, তারপর টানা চার যুদ্ধ জয় করে অস্ট্রেলিয়ার পর দ্বিতীয় সেরা দল হিসাবে সুপার সিক্সে পৌঁছানোর পর ভ্রম লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো সেঞ্চুরিয়নের মাঠে শচীনের যে মহাকাব্যিক ইনিংস ঘটে গেল সেটা সত্যি নাকি সৌরভ দের এই কামব্যাক, এই সম্মান অর্জনটা সত্যি। সাদা চোখে দুটোই চিরসত্যি, যতদিন বিশ্বকাপ থাকবে ততদিন ভারতের এই ফিরে আসা আর শচীনের মহাকাব্য ও জ্বলজ্যান্ত থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link