‘রোসেল থাকলে আমি ন্যু ক্যাম্পে যাবো না’ – ২০১৪ সালে ইয়োহান ক্রুইফ সরাসরি কথাটা বলেছিলেন। এমনকি বলেছিলেন যে, বার্সা এবং আয়াক্সের মধ্যকার ম্যাচে আমি এক’শ বার আয়াক্সকে সাপোর্ট দিবো এবং খেলা দেখতে ন্যু ক্যাম্পেও যাবো না কখনো। সান্দ্রো রোসেলের কর্মকাণ্ডে তিনি এতোটাই রাগান্বিত ছিলেন যে, চেয়ার ছেড়ে দিয়ে সোজা বের হয়ে চলে গেছিলেন।
জীবনের ১৩ টা বছর তিনি এই বার্সাকে দিয়েছিলেন। একজন খেলোয়াড়, কোচ এবং অবশ্যই বার্সার সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতা হয়ে। যখনই বার্সা বিপদে পড়েছেন তখনই ফিরে এসেছেন নিজের পরিবারের ত্রাণকর্তা হয়ে। টালমাটাল বার্সার হাত তিনি বারবার ধরেছেন। এর একটাই কারণ ছিলো তিনি বার্সেলোনা নামক এই ক্লাবকে তাঁর বুকে ধারণ করেছিলেন।
রোসেল গ্যাংয়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম ঝামেলার সূত্রপাত হয়েছিলো নেইমার ট্রান্সফার নিয়ে। ২০১৩ সালে মেসির লম্বা ইনজুরির সুযোগ নিয়ে রোসেল প্লান করে ফেলে যে বার্সার পজিশনাল বেইজ ফুটবলকে সরিয়ে অ্যাটাকিং বেইজ ফুটবল খেলাবে। এবং এতে অবশ্যই বার্সার তৎকালীন টিমের অনেক পরিবর্তন অবসম্ভাবি ছিলো।
এতোদিনের গড়ে তোলা ফুলবাগানের উপর দিয়ে চালাতে যাওয়া এই স্টিম রোলারকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি তিনি। রোসেলের এই সীমাহীন নির্লজ্জের মতো সিদ্ধান্তে একাই বাঁধা দেন তিনি। তিনি ওইসময় কিছু কথা বলেছিলেন যেগুলো পরবর্তীতে সবই ফলে গেছে।
নেইমারের প্রতিভা নিয়ে তিনি কোন প্রশ্ন তোলেননি। তিনি যেগুলোর বিপক্ষে বলেছিলেন সেগুলো হলো একজন ২১ বছর বয়সের ছেলের জন্য বার্সার দেওয়া সুযোগ সুবিধা। তিনি বলেছিলেন, সে যতই ট্যালেন্ট হোক তাঁর বয়স মাত্র ২১ বছর। সে কখনোই একজন ২৬ বছর বয়সের ফুটবলারের সুযোগ সুবিধা পেতে পারেনা।
তোমার দলে পাঁচজনের অধিক চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা খেলোয়াড় আছে তুমি কিভাবে তাদের চেয়ে এই ছেলের সুযোগ সুবিধা বেশি দিবে? এটা ফুটবলের জন্য ক্ষতিকর। এখান থেকে পাঁচবছর পরে তুমি তাহলে ওকে কিভাবে আটকে রাখবে?
তোমার দরকার একজন বিশ্বসেরা তারকা সেটা অলরেডি তোমার দলে আছে। ২৬ বছর বয়সের মেসিকে তুমি কখনোই তাঁর সঙ্গে এক পাল্লায় রাখতে পারোনা। আজ হোক কাল হোক ও এখানে টিকতে পারবেনা।
ক্রুইফ চোখে চোখ রেখে লাস্টে একটা কথাই বলেছিলেন, ‘এর জন্য তোমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। নেইমার অবশ্যই ভালো, কিন্তু এর জন্য ওকেও ধ্বংস হতে হবে।’ এই ঘটনার পরে আর বার্সার দরজা মাড়াননি তিনি। জীবন চলে গেছে তবুও ফিরে তাকাননি সন্তান তূল্য এই ক্লাবের দিকে।
রোসেলের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাল না মেলাতে পেরে ক্লাব ছেড়েছিলেন পেপ গার্দিওয়ালা। পেপকে না জানিয়ে তাঁর দলের খেলোয়াড় বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রোসেল গ্যাং এবং এও বলে যে বোর্ডের সিদ্ধান্তেই খেলোয়াড় কেনাবেচা হবে। পেপও এক মুহুর্ত দেরি করেনি তার সিদ্ধান্ত জানাতে।
বার্সার হৃদপিণ্ডকে বার্সার দেহ থেকে আলাদা করে দেয় এই রোসেল গ্যাং। পেপের পরে ক্রুইফের পরামর্শে দায়িত্ব দেওয়া হয় টিটো ভিলোনোভাকে। ভিলোনোভার ক্যান্সার সেই যাত্রা থামিয়ে দেওয়ার পরেই মূলত শুরু হয় বার্সার ভেঙে পড়া। এরপর টাটা মার্টিনোকে দায়িত্ব দিলেও সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। নেইমারের সাইনিংয়ে মানি লন্ডারিং ইস্যুতে রোসেল পদ হারালে তার স্থলাভিষিক্ত হন বর্তমান সভাপতি জোসেফ মারিয়া বার্তেমেউ।
যে গাছের যে বীজ। একই বীজে কখনো অন্য গাছ জন্মায় না। ক্রুইফ এবং পেপের চলে যাওয়ার পরে ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো মেসিও। মেসির ক্লাব ছাড়ার এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেরই। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত থেকে মেসি সরে আসে সুয়ারেজের আগমন এবং মৃত্যু সজ্জায় থাকা টিটো ভিলোনভার অনুরোধের কারণে।
২০১৪-১৫ মৌসুমে বার্সা রেকর্ড ১৬৬ মিলিয়নের খেলোয়াড় সাইনিং করে। পরের মৌসুমেই দল বদলে নিষেধাজ্ঞা পায় বার্সেলোনা। সুয়ারেজ আসার পরে তার সঙ্গে মেসির বোঝাপড়া এবং সেই মৌসুমে লুই এনরিকের অধীনে ট্রেবল সহ পাঁচ ট্রফি জেতায় সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। সেই সঙ্গে চিরতরে ধামাচাপা পড়ে যায় বার্সাকে ধ্বংস করার নীল নকশা।
এর পরের গল্প শুধুই হতাশার। নেইমার দল ছাড়ে ২০১৭ সালে। নেইমারের দল ছাড়ার পেছনে যেমন নেইমারের আর্থিক লোভকে দায়ী করা হয় ঠিক সমানভাবে দায়ী ওই বছরে বার্সার ১৬০ মিলিয়নের অর্থিক ঘাড়তি। নেইমারকে কাতারের সহযোগিতায় বিক্রি করে ক্লাবের ব্যালেন্স বুক ঠিক করে এই ম্যানেজমেন্ট।
নেইমারের আগে ক্লাবছাড়া করা হয় দানি আলভেসকে। বার্সা ছাড়ার পরেও তিনবছর ইউরোপে খেলে গেছে দানি এবং চলে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, ‘বার্সা আমাকে মিস করবে।’ তিন বছর ধরে তাকে ওয়েটিংয়ে রেখেছিল ট্রান্সফার ব্যানের দোহাই দিয়ে। অথচ শেষ পর্যন্ত তার চুক্তি নবায়ন করেনি এই ‘বজ্জাতের দল’। বোর্ডের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগই প্রমাণ করে এই বোর্ড কতটা আহাম্মক।
আজ চার বছরেও দানির রিপ্লেসমেন্ট এনে দিতে পারেনি বার্সা। আলভেসের যায়গায় একজনকে আনা হয়েছে যে তিন-চার বছরেও শিখতে পারেনি ডি বক্সের কাছে গিয়ে বল কি করতে হবে। একজন পুয়োল, জাভি, ইনিয়েস্তা, নেইমার কার রিপ্লেসমেন্ট এনে দিতে পেরেছে বার্সার এই বোর্ড?
প্রতি মৌসুমে মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়। কি ফলাফল বার্সার? বিগত পাঁচ, ছয় বছরে এক বিলিয়ন ডলারের উপরে প্লেয়ার সাইনিং করিয়েছে এই গ্যাং। মাঠের কোন পজিশনে একটা পার্ফেক্ট সাইনিং করিয়েছে তারা? প্রত্যেকটা সাইনিং টাকার ঝনঝনানি। কৌতিনহোর পেছনে দেড়শো মিলিয়নের মতো খরচ করে লোনে দিয়ে রেখেছে, ডেম্বেলে সারা বছর হাসপাতালে, সর্বশেষ গ্রিজম্যান কই খেলে, কি করে ও নিজেও জানে না কারণ বার্সার কোচরা নিজেরাই জানেনা এই দলকে কিভাবে খেলাতে হবে। একটা ওয়ার্ল্ড ক্লাস টিমকে পাড়ার টিম বানিয়ে ফেলেছে চোখের সামনে।
ক্রুইফের কথাকে অগ্রাহ্য করে যে স্যালারি স্ট্রাকচার ভেঙে ফেলেছিলো রোসেল গ্যাং, সেই ওয়েজ বিলই এখন বার্সার গলার কাঁটা। সবুরে ম্যাওয়া ফলে। রোসেল-বার্তো গ্যাং ম্যাওয়া ফলিয়ে ফেলেছে। বার্সার ‘ম্যাওয়া’ এখন লিওনেল মেসি । যেকোন ভাবেই এখন তাঁকে বিক্রি করতে পারলেই কেবলমাত্র নিজেদের পিঠ বাঁচানো সম্ভব এই মূহুর্তে।
মেসি বাই বর্ন উইনার। সে জিততে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। বিগত পাঁচ বছরে একটাও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারা টিম মেসি ডিজার্ভ করে না। রোমা ট্রাজেটির পরেও বার্সা কিছু করেনি, এ্যানফিল্ডের পরেও তাদের ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভেঙ্গেছে বায়ার্ন ট্রাজেটির পরে। কতদিন একজন মানুষ ধৈর্য ধরে থাকে?
ক্যারিয়ারের পাঁচটা বছরতো অলরেডি জলাঞ্জলি দিয়ে ফেলেছে। ক্যারিয়ারে প্রাইম টাইমগুলো বিক্রি করে দিয়েছে সস্তা দামে। এখনো তাকে বলতে হচ্ছে বার্সা তাকে কোন ভালো স্পোর্টস প্রোজেক্ট দেখাতে পারছেনা। কেন থাকবে সে বার্সাতে?
এই বার্তেমেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারবে তার ওয়েস্টেজ বছরগুলো? বার্সাকে এমন যায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে এখন মেসিকে ৭০০ মিলিয়নেই সে বিক্রি করবে। ৮০০ মিলিয়নের ঘাটতি পুরনে সে এর চেয়ে বড় অস্ত্র কোথায় পাবে? মারা গেলেও সে রিজাইন করবেনা। এই আর্থিক ঘাড়তি পুরণ করে না গেলে বার্তেমেউয়েরও আশ্রয় হবে জেলে।
মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন নোংরামি করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে সুয়ারেজের বিরুদ্ধেও নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচার। নতুন কোচ কোয়েম্যান এসেই সুয়ারেজকে নাকি ফোন দিয়ে বলে দিয়েছে বার্সায় তোমার অধ্যায় শেষ। এইটা কোন কথা? একজন ক্লাব লিজেন্ডকে ফোন দিয়ে বলে দিলো তুমি শেষ আর হয়ে গেলো?
সুয়ারেজ পরে সরাসরি বললো, ‘আমাকে যদি ক্লাব ছাড়তেই হয় তাহলে আমাকে সে সরাসরি বলুক এভাবে মিডিয়াকে দিয়ে কেন বলাচ্ছে?’ অজস্র নিউজ এভাবে দিনের পর দিন ছড়িয়ে অপমান করা হচ্ছে সবাইকে। এখন পর্যন্ত মেসি একটা কথাও মিডিয়ার সামনে এসে বলেনি অথচ প্রত্যেকটা দিন বিভিন্ন নতুন নতুন খবর ছড়ানো হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে মিডিয়াতে।
এখন ওয়েজ বিল নিয়ে বার্তেমেউয়ের খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। সেদিন তো রোসেলের সঙ্গে সেও উপস্থিত ছিলো ক্রুইফের মিটিংয়ে, তখন কেন সে কথা বলেনি? আজ ছয় বছরে যেগুলো সাইনিং হয়েছে তাদের স্যালারি স্ট্রাকচার দেখলে বিশ্বের যেকোনো ক্লাবই আঁতকে উঠবে।
ক্রুইফ বারবার বলে গেছেন, কেউ যদি তার বয়সের তুলনায় অধিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করে তাহলে তার জন্য কখনোই ফুটবল না। আজ বার্সার একজন খেলোয়াড়ও দল ছাড়তে চায় না। এরা ভালোভাবেই জানে যে, অন্য টিম এদের বর্তমান স্যালারির অর্ধেকও দিবেনা। তাঁরা কেন যাবে?
বার্সা হেরে গেলেও পরদিন তারা পার্টিতে যাবে এটাই স্বাভাবিক। গতবছর আলবার সঙ্গে নতুন চুক্তি করেছে বার্সা পাঁচ বছরের। একজন ত্রিশ বছর বয়সের প্লেয়ারের সঙ্গে বিশ্বের কোন ক্লাব পাঁচ বছরের চুক্তি করে? যেখানে তখন তাঁর বয়স হবে ৩৫ বছর। এই বছরগুলোতে কি সে এই লেভেলের পার্ফর্মেন্স দিতে পারবে ক্লাবকে? কখনোই না। মেসির সঙ্গে লাস্ট অ্যাগ্রিমেন্টের সময়ে করা প্রমিজের একটাও রাখেনি এই বোর্ড।
মূল দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের বয়স ৩০ বছরের উপরে। ইউরোপের সেরা টিমের কেন এই অবস্থা? এর একমাত্র কারণ দলে স্টার সাইনিং করাও এবং স্পন্সরশীপ থেকে বেশি টাকা ইনকাম করো। চারিদিকে শুধু টাকা আর টাকা। বার্সার জার্সি থেকে আজ ইউনিসেফের লোগো মুছে গেছে। কালিমা লাগিয়েছে এই জার্সির গায়ে।
বার্সার গর্বের জায়গা লা মাসিয়া আজ ধ্বংস। প্রতি বছরই নাম করা ট্যালেন্টগুলো একে একে চলে যাচ্ছে। কেন যাবে না? বি টিমেও চলছে সাইনিং বানিজ্য। প্রতি বছরই বাইরে থেকে প্লেয়ার কিনে এনে বি টিমে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে।
অথচ, লা মেসিয়ার প্লেয়াররা না পাচ্ছে বি টিমে প্রমোট না পাচ্ছে বি টিম থেকে মুল টিমে খেলার সুযোগ। কোন আশায় তারা পড়ে থাকবে এখানে? বার্সাকে যারা বুকে লালন করে বড় হয়েছে তাঁরা অবহেলিত। বার্সার হয়ে কারা লড়বে? ভাড়া করা লোক দিয়ে যুদ্ধ করাতে চায় এই বার্তো গ্যাঙ?
কেউ ক্লাব ছাড়তে না চাইলেও ক্লাব ছাড়তে চেয়েছে লিওনেল মেসি। যার প্রতিটা দিন কেটেছে বার্সার ঘ্রাণ নাকে নিয়ে। যখন নিজের পিতা অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন সন্তান নিজের জীবন দিয়ে হলেও চেষ্টা করে পিতৃঋণ শোধ করতে। মেসিও তাই করতে চেয়েছে। আজ বার্সা এক অসুস্থ নগরী।
বার্সার আকাশ ছেঁয়ে গেছে বার্তেমেউ নামের এক অভিশপ্ত কালো ধোঁয়াতে। এই দুর্দিনে বার্সাকে রক্ষা করার কেউ নাই তাঁর প্রিয় পুত্র ছাড়া। কিছু জিনিস পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়, কখনো কখনো সবটাই হারাতে হয়। মেসি হারিয়ে ফেলেছে সবটা। এখান থেকে পাওয়ার তাঁর আর কিছু নাই কিন্তু দেওয়ার অনেক কিছুই আছে। তাই মেসি দিয়ে যেতে চায় তাঁর সবকিছু।
নিজের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও সে চায় বার্সা ঘুরে দাঁড়াক। নাই বা উড়ুক বার্সার বুকে তাঁর বিদায়ের পতাকা, কিন্তু মেসি যে পতাকা ধারণ করেছে সেই পতাকা যেন চিরদিন উড়তে থাকে তাঁর বুকে। তাঁর বুক জুড়ে যে শুধুই বার্সেলোনা। বার্সেলোনাকে সে হেরে যেতে দেখতে পারেনা, হারার জন্য বার্সার জন্ম হয়নি।