প্রোটিয়া পেসারদের প্রতাপে ধর্মশালায় তখন রীতিমত ডাচদের ব্যাটিং দূর্গ ছত্রখান। ১৪০ রানে নেই ৭ উইকেট। বিক্রমজিৎ সিং থেকে শুরু করে বাস ডি লিড কিংবা ভ্যান বি কিক— সবাই ছিলেন আসা যাওয়ার মধ্যেই। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস। প্রোটিয়া বোলারদের চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে দলকে টেনে তুলেছেন একাই।
তাঁর ব্যাটে ভর করেই ৪৩ ওভারের ম্যাচে ১৪০ রানে ৭ উইকেট হারানো নেদারল্যান্ডস শেষ পর্যন্ত স্কোরবোর্ডে তুলেছে ২৪৫ রান। যেখানে ইনিংসের শেষ ৯ ওভারেই ডাচদের ইনিংসে যোগ হয়েছে ১০৪ রান। শুরুর ব্যাটিং ভগ্নদশায় নেদারল্যান্ডসের এমন হতশ্রী স্কোরকার্ড বদলে দেওয়ার নেপথ্যে থাকা স্কট এডওয়ার্ডস বলতে গেলে একাই লড়াই করেছেন। ৬৯ বলে ১০ চার ও ১ ছক্কায় শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকেছেন ৭৮ রানে।
অথচ ডাচদের গোটা ইনিংসে ৩০ রানের উপর ইনিংস খেলতে পারেন নি কেউ। বিবর্ণ ব্যাটিংয়ে ইনিংস শুরু। এরপর মিডল অর্ডার থেকে লোয়ার মিডল অর্ডার, কোনো পজিশন থেকেই ফুটে ওঠেনি ডাচদের ইনিংসে আশার আলো। তবে বিশ্ব মঞ্চে এসে ডাচদের এমন পরাভূত অবস্থা থেকে একাই টেনে তুলেছেন স্কট এডওয়ার্ডস।
তাঁকে অবশ্য সঙ্গ দিয়ে ছিলেন ভ্যান ডার মারউই। এডওয়ার্ডসের পর তাঁর ব্যাট থেকেই এসেচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯ রান। আর তাদের ৫৪ রানের জুটিতেই লড়াই করার মতো সংগ্রহের পথে এগিয়ে যায় ডাচরা। তবে শেষ দিকে হাতে দুই উইকেট নিয়েও দলীয় সংগ্রহকে আরো উঁচুতে নেওয়ার দিকেই চোখ ছিল এডওয়ার্ডসের। সেই ভাবনায় তিনি সফলও হয়েছেন। শেষ ৩ ওভারে ডাচদের ইনিংসে যোগ করেন ৪১ রান। আর এতেই ৪৩ ওভার শেষে ২৪৫ রানের লড়াকু পুঁজি পায় নেদারল্যান্ডস।
তবে ডাচদের ক্রিকেটে মিশে যাওয়া, ডাচ ক্রিকেট লালন করা স্কট এডওয়ার্ডস কিন্তু পুরোদস্তুর ডাচ নন। জন্মসূত্রে তিনি অস্ট্রেলিয়ান। কিন্তু ক্রিকেট এডওয়ার্ডসকে নিয়ে গিয়েছে সুদূর নেদারল্যান্ডসে। বাবা ডন, মা ক্যাথি, বড় ভাই ক্রিস, এমনকি দাদা গ্রাহাম -সবাই অস্ট্রেলিয়ান, তাঁরা অস্ট্রেলিয়াতেই থাকেন। কিন্তু এডওয়ার্ডসের দাদী ভ্যান ডার ওক আবার নেদারল্যান্ডসের। তাহলে এডওয়ার্ডসের দাদা-দাদীর এই মেলবন্ধন কিভাবে হল?
স্কট এডওয়ার্ডসের দাদা গ্রাহাম এডওয়ার্ডস তাঁর পেশাগত জীবনে ছিলেন প্রকৌশলী। একবার তাঁর কোম্পানি তাকে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে পোস্টিং দিয়েছিল। আর সেখানেই পরিচয় হয় ভ্যান ডার ওকের সাথে। এরপর তাঁরা বিয়ে করেন এবং মেলবোর্নে এসে স্থায়ী হন। স্কট এডওয়ার্ডসের দাদা-দাদীর পরিণয়ের গল্পটা ঠিক এমন।
দাদার মতো স্কট এডওয়ার্ডসের বাবাও ছিলেন প্রকৌশলী। কাকতালীয়ভাবে, এডওয়ার্ডসের বাবাকেও দুই বছরের জন্য কর্মস্থল হিসেবে হেগ শহরে পাঠানো হয়। আর এ কারণেই নেদারল্যান্ডস ক্রিকেট নিয়ে বেশ জানাশোনা হয়ে যায় স্কট এডওয়ার্ডসের।
২০১৫ সালে স্কট এডওয়ার্ডস ক্রিকেট থেকে এক বছরের বিরতি নেন। তখন পর্যন্ত রিচমন্ডের হয়ে প্রথম গ্রেড ক্রিকেট খেলা হয়নি তাঁর। এ সময়েই নেদারল্যান্ডসের রটারডাম ক্রিকেট ক্লাবে খেলা শুরু করেন এডওয়ার্ডস। কিন্তু তেমন লাইমলাইটে আসতে পারছিলেন না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি খেলতে গিয়েছিল, তা বলতে গেলে একপ্রকার বিফলেই গিয়েছিল।
তবে এরই মাঝে ২০১৬ সালে রিচমন্ডের হয়ে প্রথম গ্রেড ক্রিকেট খেলার সুযোগ পান স্কট। আর এর ঠিক এক বছর পরেই নেদারল্যান্ডের কোচ সাবেক অজি উইকেটরক্ষক রায়ান ক্যাম্পেলের কাছ থেকে ডান পান তিনি। নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ। তাই সেটি হাতছাড়াও করেননি স্কট এডওয়ার্ডস। পুরোপুরি ডাচম্যানের মতই নেদারল্যান্ডস ক্রিকেটকে হৃদয়ে লালন করতে শুরু করলেন তিনি।
২০১৭ সালে নামিবিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় এডওয়ার্ডসের। এর এক বছর বাদেই, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁর। এর পর থেকেই নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটের কমলা জার্সিতে থেকে গিয়েছেন তিনি। পিটার সিলারের অধিনায়কত্বের সময় নেদারল্যান্ডসের সহ-অধিনায়ক ছিলেন স্কট এডওয়ার্ডস। দুই বছর পর ২০২২ সালে পান অধিনায়কত্বের দায়িত্ব। আর এখানেই তিনি গড়েন অনন্য এক কীর্তি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে নেদারল্যান্ডসের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নামেন তিনি।
স্কট এডওয়ার্ডসের বয়সটা কেবল ২৭। এই সাতাশ বছর বয়সেই ডাচ ক্রিকেটের নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে। বিশ্বকাপের বিশ্বমঞ্চে এসেও দিচ্ছেন নেতৃত্ব। শুধু নেতৃত্ব বলাটা ভুল হলো। সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে নেদারল্যান্ডসে নিয়ে কেউই খুব একটা প্রত্যাশায় ডুব দিচ্ছেন না। তবে ছোট দলের বড় তারকা হয়ে ঠিকই নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করলেন স্কট এডওয়ার্ডস। বিরামহীন, দুর্বার গতির এই পথচলাকে সঙ্গী করে নিশ্চয়ই অনেক দূর যেতে চাইবেন এডওয়ার্ডস।