সম্প্রতি একটি ক্রিকেট সংস্থা তাঁদের পুরো ডিপার্ট্মেন্টকে বরখাস্ত করেছে।
এটা ভেবে নিতে খুব বেশি বুদ্ধিমান হতে হয় না যে, বরখাস্ত হওয়া সকলেই তাঁদের চুক্তির মেয়াদ পুরো করতে পারেননি। বলা হচ্ছিল বিসিসিআইয়ের কথা, নতুন নির্বাচক খুঁজে নিতে ইতোমধ্যেই বিজ্ঞাপনও দিয়েছে তাঁরা। কিন্তু আগুনের জুতায় পা গলানোর এই পদে কে আবেদন করবেন?
ভারতে কেবল বিসিসিআইয়ের একাধিপত্য চলে না, বরং আপনি যদি সাবেক ক্রিকেটার হন এবং তাঁদের বিপক্ষে কথা বলেন তাহলে কখনোই কাজ পাবেন না। ধারাভাষ্যকার, কোচ, স্কাউট, আম্পায়ার, কিউরেটর, সংবাদকর্মী, নির্বাচক সবখানেই বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) কর্তাদের প্রভাব বিদ্যমান। সুতরাং এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নতুন নির্বাচক খুঁজে নেয়াটা কি কঠিন কিছু হবে?
হয়তো না, অগণিত মানুষই হয়তো অ্যাপ্লাই করবেন নির্বাচক হওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁদের মাঝে কজন যোগ্য কিংবা তাঁদের বাছাই করার মানদন্ডটাই বা কি? এসব প্রশ্নের উত্তর আজ ধোঁয়াশা। ধারাভাষ্যকারের কাজটা তুলনামূলক সহজ, মিডিয়ায় তাঁদের পরিচিতি বিস্তর। তাছাড়া আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব থাকায় কাজের সুযোগও বেশি। কোচেরা চাকরিতে বেতনটা চড়া, হুটহাট বরখাস্তের ভয় থাকলেও অর্থের নিশ্চয়তা থাকায় খুব একটা সমস্যা হয় না।
কিন্তু নির্বাচকদের ক্ষেত্রে খ্যাতি কিংবা অর্থ কোনোটারই নিশ্চয়তা থাকে না। ক্রিকেটের সবচেয়ে মেধাবী এবং তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মানুষরাই নির্বাচকের দায়িত্বটা পালন করতে জানেন। ১২০ কোটির মাঝে থেকে মাত্র ২৫ জনকে বাছাই করার কাজটা মোটেও সহজ কথা নয়। দল থেকে কাউকে ছেঁটে ফেলার নিষ্ঠুর কাজটাও করতে হয় তাঁদের।
ভারতের মতো দেশে ক্রিকেটে প্রতিভার অভাব নেই। সেকারণে নির্বাচকদের সর্বদা চোখকান খোলা রাখতে হয়, দলের জন্য সেরাদেরই বেছে নিতে হয়। জহুরির চোখ দিয়ে সেরা ২৫ জনকে দলে ডাকতে হয়, বাকি ২৫ জনকে বাছাই করতে হয় ভবিষ্যতের প্রশ্নে। টিভিতে খেলা দেখে কিংবা ইন্টারনেটে স্কোরকার্ড দেখে কাজটা করা সম্ভব নয়, গোটা ভারতবর্ষের স্টেডিয়ামে যেতে হয় খেলা দেখতে।
কাশ্মীর থেকে কন্যা কুমারী সবটাই থাকতে হয় নখদর্পনে। যেসব ম্যাচ সরাসরি দেখার সুযোগ হয় না, সেসব ম্যাচের জন্য যোগাযোগ রাখতে হয় জুনিয়র নির্বাচক, কিউরেটর, স্কাউট এবং ক্ষেত্রবিশেষে আম্পায়ারদের সাথেও। দেশের আনাচেকানাচে থেকে উপযুক্ত প্রতিভাকে খুঁজে এনে তাঁর পরিচর্যার দেখভালও করতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় জাতীয় দলের কোচ এবং কাপ্তানের চাহিদার দিকেও।
করোনা মহামারির আগের সময়টাতে ভারতীয় নির্বাচকরা এভাবেই কাজটা করতেন। এ দল নিয়মিত বিদেশ সফরে যেতো, জাতীয় দলের বাইরের ক্রিকেটাররা সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন। কিন্তু করোনা মহামারীতে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়লে সেই সিস্টেম ভেঙে পড়ে এবং নতুন ক্রিকেটার দলে মানিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের গতিটাই সবচেয়ে ধীর।
সত্যি বলতে পূর্বে নির্বাচকরা আর বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেতেন। দলের ভবিষ্যতের প্রশ্নে নিষ্ঠুর কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হতেন না, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা আসতো তাঁদের পক্ষ থেকেই। হ্যাঁ, টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচ কিংবা অধিনায়কের সাথে আলোচনার মাধ্যমেই সারা হতো সব, তবে শেষ কলটা ছিল নির্বাচকদের হাতে।
কাগজে কলমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নির্বাচকদের হাতে থাকার একটা তাৎপর্য আছে। সদ্য বরখাস্ত হওয়া চেতন শর্মার নির্বাচক কমিটি সেটা ভালোই জানেন। বোর্ড সভাপতি কিংবা সেক্রেটারি যদি এত সহজেই তাঁদের বরখাস্ত করতে পারেন, তবে প্রতিটি সভায় সেক্রেটারি কেন উপস্থিত থাকতেন, সভাপতিই কেন দল নির্বাচন অনুমোদন করবেন?
এবারের নির্বাচক কমিটি বেছে নেয়া আগের প্রতিবারের চাইতে আলাদা। কারণ ভারত পার করছে তাঁদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। টানা দুই টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর আগামী বছর ঘরের মাঠে বসবে বিশ্বকাপের আসর। সুতরাং নতুন নির্বাচক কমিটির হাতে থাকবে অনেক কাজ। দলটাকে প্রস্তুত করে তোলার পাশাপাশি পাইপলাইন আরো শক্তিশালী করে তুলতে পুরনো সিস্টেমটাকে আবারো চালু করতে হবে।
জাতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড় এবং একাডেমীর ভিভিএস লক্ষণের সাথে মিলে জাতীয় দলের জন্য যোগ্যদের বেছে নিতে হবে। কোর্টের আদেশে বিসিসিআই যখন কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছিল তখন জাতীয় দলের কোচ রবি শাস্ত্রী, এ দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড় এবং নির্বাচক প্রসাদ একত্রে কাজ করছিলেন।
তাঁদেরকে আরো বুঝতে হবে ভারতের আসলে কি দরকার? কাজগুলো ঠিকমতো করতে ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট নাকি সাদা এবং লাল বলের জন্য আলাদা আলাদা কোচ। এছাড়াও নির্বাচক দলেরও কি অ্যানালিস্ট থাকা উচিত বা জুনিয়র নির্বাচক কমিটিতে খানিকটা তরুণ কেউ যিনি কিনা টি টোয়েন্টিটা ভালো বুঝেন।
খুব শীঘ্রই ভারতের নতুন নির্বাচক কমিটি হয়তো দায়িত্ব বুঝতে নেবে। আশা করি তাঁরা টিম ম্যানেজমেন্টের সাথে মিলে দলের জন্য উপকারী সব পদক্ষেপ নিবেন। অন্যথায় বিশ্বকাপ এবং টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপকে সামনে রেখে ভারতের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন সময়।